খাতুনে জান্নাত
ব তে বর্ণমালা ব তে বাংলাদেশ
তোমাকে লিখতে লিখতে ঐতিহ্য
তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে অহংকার।
শিশিরভেজা সরিষা ফুলের ভোর আসে।
কেঁচোর মতো গড়িয়ে গড়িয়ে ইচ্ছে সুফলা করে মনের পোয়াতি রঙ।
জীবন তো ঘাই হরিণী।
একটু শ্বাস নেবার জন্য তুমি ছায়ামায়া বটবৃক্ষ।
একটু বেঁচে থাকার জন্য স্বরবর্ণ সংসার।
আমাদের চিনে না কেউ আমরাও কাউকে
নির্জন দ্বীপের মতো নদীর মোহনায় বুদ্বুদহীন...
জীবনের খোলা আটপৌরে
ভুলের শব্দ ভেঙে গড়েছি ভাষার মিনার।
সুউচ্চ মিনার ধরে আহ্বানের সুর ভেসে যায়...
চারিদিকে শব্দের স্রোত, কিসের আহ্বান?
মেলার বসন কিংবা ফোনের রিংটোন
সোস্যাল বাতায়নে শব্দের প্রসার।
ইচ্ছেমতো শব্দ গড়ে
অন্যের ইচ্ছার ঘাড়ে বসায় সাড়ম্বরের গাঢ় বিষদাঁত...
পড়ে থাকি কবরের স্তব্ধতায়
অথচ শিশুরা বাড়ে ব্যঞ্জন বর্ণের স্বমিলে জন্মের কোলাহলে...
প্রজন্মের সিঁড়ি ভাঙে কোন চেতনায়!
ভেঙে ভেঙে তৈরি হয় ঈর্ষার বাগাড়
বিভেদের জামা গায়ে ভিন ভাষার ডাগর চোখ কাকে চায়?
এক ঘরে সহস্র দোলক
অহংকারের সুরম্য প্রাসাদে বর্জিত ভাষার লোভের নোলক!
পাথর কাটতে কাটতে পথ
কতবার বাঁচতে বাঁচতে
নিজেই নিজের শবে দিয়েছি আগুন
শতরূপে তুমি এসে ভেসে যাও অচ্ছ্যুত ফাগুন...
এমন প্রভাতও আসে-
পাতায় পাতায় বর্ণমালা বাতাসে শ্লোগান...
রফিক উদ্দিন,
শফিউর রহমান ,
আব্দুস সালাম
আব্দুল জব্বার
আবুল বরকত,
অহিউল্লাহ
আব্দুল আউয়াল
সিরাজ উদ্দিন
দ্যুতিভরা নাক্ষত্রিক নাম।
৯, ২৬ কিংবা ৪০
সংখ্যা যাইহোক হাজার সমান।
তোমরা দিয়েছিলে গীত নীড় ও পাখির রীত
প্রীতিমাখা লতার দোলনা,
কৃষক, কুলি, মুটে, মেথর,
গার্মেন্টস শ্রমিকের অন্তহীন শ্রম
কর্মময় জীবনের ডাক
আমরা পেয়েছি মিথ--
ভাষার আহ্বান...
এমন প্রভাত আসেনি বহুকাল
শীতের কুয়াশার গায়ে রোদের চাদর
তুমি দিয়েছিলে শিস, উর্মীর আদর
আমি নিয়েছি মিলমিশ আকাশ পোশাক পরে ভেঙেছি অভিমান ।
দিনের আঁচল মাখা কলির সুবাস
কল কল স্রোত বয় ডাকছে ফাগুন
ধমনিতে উজ্জীবিত রক্তের আগুন
তুমি দিয়েছিলে ব্যথার যতি গতির সাম্পান
ভুলের সাঁকো পেরিয়ে পথের নাগাল
এমন সকাল আসেনি বহুকাল
পাতায় পাতায় বর্ণমালা বাতাসে শ্লোগান...
২.
ভাষা ও বর্ণ।
স্লেট‐কোলে দিনকাল মুক্তো ছড়ায়,
কুলায় ঝেড়ে নিই আতপ জীবন
ঘুরেফিরে মিহিন মৌসুম থেকে ছিঁটেফোঁটা স্মৃতির দহন
ঢেঁকিছাটা চাউলে আবীরমাখা জাউভাত
রোদ‐সুখ, পাখার বাতাস, ছড়াকাটা প্রহর প্রহারে।
তুমি-আমি চিনি না কাউকে
দিনগুলো চিনে রাখে
এখনো পথের বাঁকে হাত ইশারায় থামায় পলক
প্রাকৃত জনের কাছে শেখা সেই বর্ণের বাতাস
হাতপাখা দুপুর মায়ের কোল ঘেষে মেনিবিড়ালের আদরে
জাফরান দিন
সুষমা পলির গান
ছড়া আর গান
পিঠে-ভাজা ঘ্রাণ
আদরে উৎসুক শাসনেরও জোর কলেবরে
অক্ষরেরা এলিয়ে নেতিয়ে থাকে
স্লেটে, খাতায়, ঝরা পৃষ্ঠার প্রদেশে...
মা’র কাছে শিখেছি সবক
ভাইবোনের কাছে শিখেছি সবক
সেই বোন সেই মা
সেই দাদীমা বিহীন বাবার নির্জন গল্প-বলা রাত
ছুটে যায়, আধা আধো সীমানা ডিঙ্গায়
দিনের ভিতর রাত রাতের ভিতর দিনরাত নেয়া
সহস্র জাগ্রত কাল--
দৈনন্দিনে মিশে থাকে ভাষা শহীদেরা
এ অক্ষর ও জোতির্ময় দিনের আভায়...
ভাষা শহীদেরা অমর অজয়
দীর্ঘ দীর্ঘ দিন পার হলে
বটমূলের পাদদেশে চৈতালী রাতের পালাগান
শ্রদ্ধা ও আনত চোখের ভাষা ও ভাটিয়ালি
বিশ্ব বাগানে ফসল ফলায়
যে পথের বাঁক চলে গেছে আকাশ পথের ধারে
প্রিয় রঙ, প্রিয় প্রিয় ভুলগুলো স’য়ে ধানকাটা শেষে
শুয়ে থাকে ক্লান্তির ক’ফোঁটা ঘাম ও তৃষ্ণাসহ
খাতা থেকে যে ক’টা পৃষ্ঠা ছিঁড়ে উড়িয়েছে ঘুঁড়ি ও রকেট
শৈশব খুঁজছে পথ
যুবাকাল খোঁজে পথ
পৌঢ়ত্ব খোঁজে অন্তঃদহন থেকে মুক্তির ভাসান
যে পথে হয়নি যাওয়া কোন কালে
মুক্তির মিছিলে তারাও শামিল হয়
লক্ষ এক ভাষা ও শ্লোগান
যে পূর্বজন পাহারায় আছে শিউলি বিছানো বাগিচায়
আশির্বাদ হ’য়ে ঝরে ফুল, আমরা কুড়াই।
জীবনের প্রথম ও শেষ গান অনন্ত দহন
মুক্তির মুক্তাঙ্গনে স্বাধীনতার অনন্ত সুখের স্মরণ
এ সবের ভাষা এক
স্বপ্নের ভাষাও এককে মিলায়...
৩.
একুশ
ঘুমের ভেতর কাঁপে--
শৈশবের আধছেঁড়া ধারাপাত,
ভোরের সারগাম।
মা নেই, রয়ে যায় মায়ের অক্ষর।
টুনটুনি দোয়েলের শিস
ডাল -ডুমুরের প্রাণ
সাথে কিছু মাটিয়া নির্যাস
কচু ও ঘেচুর স্বাদ--
আঁচলে নিয়েছি বেঁধে
ছড়িয়েছি পথেঘাটে
কত যে বাড়তি ব্যয়।
ঘামের গরল কুরে
দূরত্ব ধোঁয়াশা ফোঁড়ে
চকিতে কে ডাকে!
ভাসে ও বর্ষণ হয়
ভাষার অহংবোধে একুশ বিস্ময়!
৪.
উজ্জীবন
চেতনার গৌরবে ভাসিয়ে রক্তবন্যা.
গর্বিনীর সন্তানেরা তুলে আনে তোমার তিলক..
উদ্দীপ্ত হয় চির আক্রান্ত মাটির শ্যামল হৃদয়।
সে হৃদয়ে চালায় কে যেন শাবল কোদাল;
করোটির আঁকে বাঁকে গেঁথে দেয় ধূসর পেরেক।
বর্ণমালা আসো আঁতুর ঘরের শিয়রে দাঁড়াই।
সদ্য জন্ম-নেয়া শিশুর বিস্ময় নিয়ে
পরিচিতের আসর ধ্বনিত যেখানে...
আসো প্রিয়তমের কোমল করতলে
বিশ্বাসের দৃঢ় চাপ হ’য়ে দেই বন্ধনের নির্মল টান।
যেভাবে গোপন চিঠির খাম--
ভগ্ন-ভালোবাসার নির্মাণে হই একাত্ম
বিভেদ আর ভুলের সমাপ্তিতে।
.
চেয়ে দেখো--
ভালোবাসাহীনতায় জন্মনেয়া উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টির অন্দরে
কী নিরুদ্বেগে ঢোকে দুষিত বাতাস!
ভগ্ন মেরুদন্ডের মজ্জায় নির্লজ্জ চাটি মারে
অন্ধকারের বিহ্ববল আবেগ!
এসো প্রিয় শব্দের আদরে
হাত ধরাধরি করে হাঁটি ঐতিহ্যের আবহে
মাটির অতল থেকে তুলে আনি শস্যের আদি নির্যাস
সৌরভে যার পূর্ণ ছিল একদা--
আড়ত , গোয়াল, পুকুর, সবুজ বন ও ফলের সমারোহ।
ও বর্ণমালা তুমি উঠে আসো
প্রাকৃত জনের হয়ে পূনরুদ্ধারে আপন অহং
প্রাণের প্রিয় ভিটায় জ্বালো অবিরাম,
ভালোবাসার দীপ অনির্বাণ।