• নরসিংদী
  • শনিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

Advertise your products here

Advertise your products here

নরসিংদী  শনিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ;   ২১ ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
website logo

বাংলা সিনেমার প্রথম নায়িকা


জাগো নরসিংদী 24 ; প্রকাশিত: শুক্রবার, ০৮ জুলাই, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ১২:৪৮ এএম
বাংলা সিনেমার প্রথম নায়িকা
ছবি : সংগৃহীত

নূরুদ্দীন দরজী

বাংলা সিনেমা এক সময় পরিচিতি পেয়েছিল সুচিত্রা সেন ও উত্তম কুমারের হাত ধরে। এ জুটির অভিনয় দর্শকদের হৃদয়ে ঝড় তুলতো ও মোহবিষ্ট করে রাখতো। বাংলার পথে প্রান্তরে, আনাচেকানাচের সিনেমাপ্রেমী মানুষের মনে স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছিলেন সুচিত্রা সেন। কিন্তু তার আগে? হ্যা, সুচিত্রা সেনদের আগে ও দর্শক ছিলেন, তাঁদের মনোরঞ্জনের জন্য কেউ না কেউ ছিল। এমনি একজনের নাম কানন বালা দেবী। তিনি ছিলেন বাংলা সিনেমার প্রথম নায়িকা। বলতে গেলে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের পূর্বের দর্শকদের নায়িকা ছিলেন তিনি। তখনকার যুগের সেরা নায়িকা। সুচিত্রা সেনের চেয়ে কম ছিলেন না কোন অংশেই । কানন বালার অনবদ্য অভিনয়ে সেসময়ে সিনেমা পাগল মানুষ দারুন মুগ্ধ ছিল।

উল্লেখ্য যে,আদিকালে মানুষের বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল যাত্রাভিনয়, লাঠিখেলা, ঘোড় দৌড় ইত্যাদি। কালক্রমে আসে বায়োস্কোপ। বায়োস্কোপের চিন্তা থেকে সিনেমার কথা মাথায় আসে। শুরু হয় চলচ্চিত্র বা সিনেমা তৈরির প্রচেষ্টা। বিষয়টি খুবই কঠিন ছিল। বর্তমান সময়ের মত প্রযুক্তি বলতে কিছুই ছিলনা। আবার রক্ষণশীল সমাজে মেয়েদের প্রকাশ্যে অভিনয় করা ছিল আর ও কঠিনতর।

ছেলেরা মেয়ে সেজে মেয়েদের ভূমিকাভিনয় করতো। এমন কঠিন যুগে সাহস করে ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রথমে বায়োস্কোপ ও পরে সিনেমায় পা রেখেছিলেন কানন বালা দেবী। তাঁর আগে এমন সাহস দেখানো মেয়েদের জন্য খুবই দূরূহ ছিল।। এ জন্যই তাঁকে বলা হয় বাংলা সিনেমার প্রথম নায়িকা। এ নায়িকার জীবন ছিল বড়ই বৈচিত্রময় ও দুঃখ শোকের এক মহাকাব্য।

কানন দেবীর জীবনের খুব কম‌ই জানা যায়। আর যতটুকু জানা যায়, তাঁর জন্ম হয়েছিল ১৯১২ সালে বা কার ও মতে ১৯১৬ সালে কলকাতায় । তাঁর মা রাজবালা দেবী ও বাবা রতন চন্দ্রকে নিয়ে কথা উঠেছিল। তারা নাকি বৈধ স্বামী-স্ত্রী ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের আদর স্নেহেই কানন বড় হতে থাকেন। কাননের পাঁচ বছর বয়সে বাবা রতন চন্দ্র মারা যায়। মা রাজবালা মেয়েকে নিয়ে পড়ে যান কঠিন বিপদে। উপায় না পেয়ে নিষিদ্ধ পল্লীতে এক আত্মীয়ের কাছে আশ্রয় নিয়ে ঝিয়ের কাজ শুরু করেন মা
ও মেয়ে দুজন‌ই। বাবা রতন চন্দ্রের এক সময় কিনে দেওয়া বইগুলো পড়ে পড়ে নিজেকে চিনতে থাকেন। কঠিনতর অবস্থায় থেকে ও কানন নিজ প্রচেষ্টায়" জয়দেব,নামক সিনেমায় শিশু শিল্পী হিসেবে অভিনয়ের সুযোগ করে নেন। শুরু হয় তাঁর পথ চলা।

১৯৩১ সালে"ঋষির প্রেম,ছবিতে প্রথম নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন। এর পর থেকে তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ধীরে ধীরে হয়ে উঠেন বাংলা ও হিন্দি সিনেমার একছত্র কর্ণধার। নিয়ন্ত্রণ করতেন ভারত বর্ষের সিনেমা জগত, বিশেষ করে এক সময় বাংলা সিনেমার আদি-অন্ত কাননের হাতে চলে এসেছিল। । কাননের বিপরীতে নায়কগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রমথেশ বরুয়া, সায়গল,ও পাহাড়ী সান্যাল। সমসাময়িক অভিনেত্রীরা ছিলেন,যমুনা বরুয়া,দেববালা, উমাতারা প্রমুখ।

তাঁর অভিনিত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে ঋষির প্রেম,মা,কন্ঠহার, মানময়ী গার্লস স্কুল,যোগাযোগ, বিষবৃক্ষ, পরাজয়,মুক্তি,পরিচয়,বিদ্যাপতি মেজদিদি ও শেষ উত্তর। শশধর দত্তের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত শেষ উত্তর, সিনেমাটি দারুন উপভোগ্য। বাংলা ও হিন্দিতে ডাবিংকৃত ছবির গান"তুফান মেইল যায়, যায়-তুফান মেইল/ তুফান মেইল ও দুনিয়া --- এর সুরে মন কেড়ে নেয়। শেষ উত্তর ছবিটি দেখার জন্য দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রুচিশীল নাচ কাকে বলে দেখতে হলে কানন বালার নাচ দেখতে হবে।

তাঁর অভিনয় দর্শক মনে দাগ কাটতো। অভিনয়ে অনেকেই মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। একবার রুপবাণী সিনেমা হলে তাঁর অভিনিত ছবি চলার সময় একটি রোমান্টিক দৃশ্যে এক মোহগ্রস্ত দর্শক তাঁকে ধরার জন্য পর্দায় ঝাঁপ দিয়েছিল বলে শোনা যায়।

কানন বালা ছিলেন বাংলা গানের ও প্রথম গায়িকা । ছিলেন সুগায়িকা। তালিম নিতেন আল্লারাক্ষা খাঁ ও কাজী নজরুলের নিকট। আধুনিক গানের পাশাপাশি গাইতেন রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত। গান শুনিয়ে একবার রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিলেন। তাঁর কন্ঠে নজরুলের ,ছন্দে ছন্দে দোলে আনন্দে, আমি বনফুলগো গানটি ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে।

ব্যক্তিগত জীবনে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন ব্রাম্মনের ছেলে অশোক মৈত্রকে। কিন্ত্র ‌অশোকের শিক্ষাবিদ বাবা ঐ বিয়ে মেনে নেননি। পরে আবার বিয়ে করেন হরিদাস ভট্টাচার্যকে। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে তাদের ও বিচ্ছেদ হয়ে যায়। জীবন কাটতে থাকে একাকিত্বে। একমাত্র বাগান পরিচর্যা করে, ব‌ই পড়ে ও গান শুনে সময় কাটাতে হতো। ১৯৯২ সালের ১৭ জুলাই এ বিখ্যাত অভিনেত্রী অসহায় অবস্থায় কলকাতার বেল ভিউ হাসপাতালের একটি কেবিনে মৃত্যু বরণ করেন।

এ কেবিনেই ২০ বছর পরে মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের মৃত্যু হয়েছিল। আর এ ভাবেই শেষ হয়ে যায় একটা কঠিন সময়ে নানাবিধ প্রতিকুলতা অতিক্রম করে বাংলা সিনেমায় মেয়েদের এগিয়ে নেওয়া অভিনেত্রী কানন বালার। যার সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই হয়তো কিছুই জানে না।

লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)

মতামত বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ