• নরসিংদী
  • শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

Advertise your products here

Advertise your products here

নরসিংদী  শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ;   ২৭ এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
website logo

সংবাদ-সাংবাদিকতা; সাংবাদিকদের অবস্থান, ন্যায়বোধ ও দায়বদ্ধতা


জাগো নরসিংদী 24 ; প্রকাশিত: বৃহস্পতিবার, ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ০২:০১ এএম
সংবাদ-সাংবাদিকতা; সাংবাদিকদের অবস্থান, ন্যায়বোধ ও দায়বদ্ধতা

মো. শাহাদাৎ হোসেন রাজু: যিনি সংবাদ বহন করেন,পরিবেশন করেন এককথায় আমরা তাকেই সাংবাদিক বলি? । কিন্তু সংবাদপত্র কিংবা গণমাধ্যমে যারা কাজ করেন তারা কি প্রত্যেকেই সাংবাদিক। প্রচলিত গণমাধ্যমের বাইরেও এখন অনেক মাধ্যম আছে যেখানে এই সংবাদ পরিবেশনের কাজটি করে থাকেন অনেকে। যে যেখান থেকেই সংবাদ পরিবেশন করুন সেটা এই আলোচনার মুখ্য বিষয় নয়; সংবাদ পরিবেশনের সত্যতা, ন্যায়বোধ, এর সামাজিক প্রভাব এবং তাদের দায়বদ্ধতা সেই সাথে নিজেদের পদমর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণাএই বিষয়গুলো নিয়েই মূলত এই আলোচনার বিষয়।

একজন পেশাগত সাংবাদিক যখন ‘ভাড়াটে’ লোকের মতো তার পেশাকে ব্যবহার করেন তখন সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য বড় বিপদ ডেকে আনতে পারেন। এখন বহুল আলোচিত উচ্চারিত দুটি টার্ম হচ্ছে- হলুদ সাংবাদিকতা ও অপসাংবাদিকতা। কিন্তু পেশাগত সাংবাদিকতার বাইরেও এখন অসংখ্য সংবাদ পরিবেশন হয় যার প্রভাব এত বেশি, যা কখনো কখনো পেশাগত সংবাদকেও প্রভাবিত করে। যার কারণে কখনো কখনো অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার কিছু কিছু মিথ্যা সংবাদ বা গুজব মূলধারার গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রদান করে জনগণকে সচেতন করতে হয়। আবার মূলধারার গণমাধ্যমও অনলাইন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে বাধ্য হয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন। সংবাদ যিনি পরিবেশন করবেন তার প্রধানতম কাজই হলো সংবাদের সত্যতা নিশ্চিত করা। নিজের বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকা।

সাংবাদিতকার নিয়মতান্ত্রিকতায় এভাবে বলা যায়- সংবাদ সংগ্রহ করা, সংবাদের সত্যতা যাচাই করা, তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করা, সংবাদ সম্পাদনা করা, প্রয়োজনে মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়া, বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করা, কলাম লেখা ও বাছাই করা, প্রয়োজনীয় ছবি সংযুক্তকরণ ইত্যাদি। পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা একটি মননশীল কর্ম নিঃসন্দেহে বলা যায়। পেশাদারিত্ব এবং সাহসিকতার সাথে যারা এই কর্মে যুক্ত তারা নানান সময় নানান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। সেখানে টিকে থাকাটা অনেকটা যুদ্ধের মত। এই যুদ্ধে সংবাদকর্মীর অস্ত্র কলম। কিন্তু যিনি পেশার বাইরে থেকে সংবাদ পরিবেশন করেন, সংবাদ ছড়িয়ে বেড়ান, সেই সংবাদে জনসাধারণে পেনিকও তৈরি হয় এবং এই সংবাদ কিছু মানুষ বিশ্বাসও করে। যেখানে সেন্সরের কোনো সুযোগ থাকছে না। সেই সংবাদের দায়বদ্ধতা কোথায়! নিজের বিবেক আর ন্যায়বোধের তাড়না। বিবেকই যেখানে একমাত্র মানদণ্ড। সেখানে তার চাকরি হারাবার ভয় নেই। যার কারণে অনেক সত্য এবং সাহসী উচ্চারণও আজকাল দেখা যায় নিয়মতান্ত্রিক প্রথাগত মিডিয়ার বাইরে এই সোশ্যাল মিডিয়ায়।

সাংবাদিকের দায়িত্ব, কর্তব্য, মর্যাদাবোধ, কাজের পরিধি, সীমানা এমনকি এই গুরুত্বপূর্ণ পেশার ঝুঁকি, সামাজিক বাস্তবতা ইত্যাদি বিষয়াদি বিবেচনা করে কেউ ফেসবুকে পোস্ট দেয় না। এখানে সে স্বাধীন। স্বাধীন চিন্তায়, স্বাধীন সংবাদ পরিবেশনে, স্বাধীন পেশাদারিত্বের জায়গায় চাকরি হারানোর ভয় থেকে। এখানে সংবাদ যিনি পরিবেশন করবেন তিনি একক ব্যক্তি, সমাজের কাছে তার দায়বদ্ধতার চিন্তাও নেই। কিন্তু একজন পেশাদার সাংবাদিক জানেন সংবাদপত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। আর এ কারণে তাকে সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে হয়। সে জানে সাংবাদিতকা শুধু জীবিকার মাধ্যম নয়, দেশ-জাতি এবং মানুষ ও মানবতার কল্যাণে সেবার মাধ্যমও বটে। আর এই পেশার কর্মীদের ওপর বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের কারণে যখন নির্যাতন নেমে আসে তখন স্বভাবতই আমরা মর্মাহত হই। মনোভাব প্রকাশের শেষ আশ্রয়স্থল যখন প্রভাব প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার ওপরওয়ালার চাপে কণ্ঠরোদ্ধ হয় তখন আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। আবার কোন কোন সাংবাদিক ব্যক্তিগত স্বার্থ ও রাজনৈতিক বিবেচনায়, নির্দিষ্ট এজেন্ডা কিংবা প্রলোভনের কারণে সাংবাদিকতার নীতিমালা এবং কর্তব্যবোধ বিসর্জন দিচ্ছেন।

সাংবাদিকতায় আরেকটা বিষয়ে সাংবাদিকদের গুরুত্ব দিতে হয়। সেটা হচ্ছে একজন সাংবাদিক বা সংবাদকর্মীকে তার নিজের অবস্থান বা পদমর্যাদা কতটুকু, কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হবে এবং কাকে কি বলে সম্মোধন করতে হবে। সাংবাদিক বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করতে গিয়ে এ বিষয়ে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। অবশ্য অনেক গণমাধ্যম তাদের প্রতিনিধি সম্মেলনগুলোতে এ বিষয়ে ধারণা দিয়ে থাকে। আমাদের দেশের মফস্বল সাংবাদিকদেরমধ্যে হাতেগোণা দুই একজন ছাড়া বাকিরা জানেই তাদের অবস্থান ও পদমর্যাদা কতটুকু এবং কার সাথে কি শোলভ আচরন করবে।মফস্বল শহরগুলোতে প্রায়শ: কোন কোন সাংবাদিককে একজন পুলিশ কনস্টেবলকে স্যার বলে সম্মোদন করতে শুনা যায়। যা মোটেই কাম্য নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন থমাস জেফারসন টমাস জেফারসন (১৩ এপ্রিল ১৭৪৩- ৪ জুলাই ১৮২৬) একজন মার্কিন রাজনীতিবিদ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি। তিনি ছিলেন একজন রাজনীতিক দার্শনিক। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূল রচনাটিও তিনি করেছিলেন। জেফারসন ছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে একজন প্রবাদপুরুষ। তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি এই বিকল্পটি দেয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেবো।’ জেফারসন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সংবাদপত্রের কথা বলেছিলেন। এর প্রায় ৫০ বছর পর ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনাপার্ট সংবাদপত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, চারটি আক্রমণাত্মক সংবাদপত্র হাজারটা বেয়নেটের চেয়েও ক্ষতিকর।’ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না। যুগ যুগ ধরে মানুষ সংবাদ, সংবাদপত্র, স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, আবার এটিও উপলব্ধি করেছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যদি সঠিকভাবে ব্যবহার করা না হয় অথবা সংবাদমাধ্যম যদি কোনো দুরভিসন্ধি নিয়ে অসত্য বা অর্ধসত্য সংবাদ প্রচার করে, তা দেশ, জাতি ও সমাজের ক্ষতির কারণ হতে পারে। আমার দৃষ্টিতে সাংবাদিতকা অনেকটা নবুয়াতি দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কারণ সংবাদপত্রকে প্রতিটি সকালের আলোতে পাঠকের সামনে আসতে হয় সত্যবাদিতা ও ন্যায়নিষ্ঠার সংবাদ নিয়ে। প্রতিনিয়ত তাই সে জবাবদিহিতার মুখোমুখি। তার সংবাদ হতে হয় বস্তুনিষ্ঠ, স্বচ্ছ-সুন্দর, ইতিবাচক ও দায়িত্বশীল। সাংবাদিকের দায়িত্বও তাই- সত্য উদঘাটন ও সত্যের বিকাশ ঘটানো। আর এ কারণে একজন সাংবাদিককে আত্মসচেতনতার মাধ্যমে পেশার দায়িত্ব ও নির্দেশনা মেনে চলতে হয়। যেহেতু সাধারণ মানুষের জীবনে গণমাধ্যমের সরাসরি প্রভাব রয়েছে, সেহেতু বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা একজন সাংবাদিকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের পাঠকের কাছে The New York Times আর The Washington Post এর গ্রহণযোগ্যতা অনেক। যুক্তরাষ্ট্রে এ দুটি পত্রিকা যে দলের বা ব্যক্তির পক্ষে অবস্থান নেয় সেই দলের বা ব্যক্তির যেকোনো নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা অনেক গুণ বেড়ে যায়। CNN-এর বিশ্বাসযোগ্যতাও মানুষের কাছে যথেষ্ট ভালো। অন্যদিকে ফক্স টিভিকে মনে করা হয় রিপাবলিকান দলের অন্ধ মুখপত্র। ব্রিটেনে গার্ডিয়ানে কিছু প্রকাশিত হলে তা মানুষ বিশ্বাস করে। বিবিসি আর চ্যানেল ফোরের বিশ্বাসযোগ্যতা এখনো ভালো। পাঠকের ধারণা, এসব বিশ্বাসযোগ্য গণমাধ্যম নিজস্ব কোনো গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করে না। তারা যা পরিবেশন করে তা বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দি হিন্দু, স্টেটসম্যান, ইন্ডিয়া টুডে, এনডিটিভি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে বলে পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে।

গণতন্ত্র, সুশাসন ও উন্নয়নের সাথে গণমাধ্যমের রয়েছে নিবিড়তম সম্পর্ক। সুতরাং বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ এবং ন্যায় নির্ভীক সাংবাদিকতা ছাড়া সত্যিকারের গণতন্ত্র সম্ভব না, গণতন্ত্র ছাড়া সুশাসন দুরাশা, সুশাসন ছাড়া টেকসই উন্নয়নও হবে না। অভিধানে হলুদ সাংবাদিকতার একটা চমৎকার সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে এভাবে, Dishonest in editorial comment and presentation of news especially in sacrificing truth for sensationalism. অর্থাৎ অসাধু সম্পাদকীয় নীতি অবলম্বন এবং সংবেদনশীল সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সত্যকে জবাই করা। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে বলা হয়েছে, Journalism that is based upon sensationalism and crude exaggeration. অর্থাৎ সংবেদনশীলতা এবং যাচাইবিহীন অতিরঞ্জিত সংবাদ পরিবেশন করা। ইংলিশ ডিকশনারিতে হলুদ সাংবাদিকতার অর্থ করা হয়েছে, The Type of Journalism that relies on Sensationalism and Lurid exaggeration to attract readers. অর্থাৎ পাঠককে আকৃষ্ট করারা জন্য সংবেদনশীলতা রঙ মিশিয়ে এবং উত্তেজনাকর বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সংবাদ পরিবেশন করা। এসব সংজ্ঞা মিলিয়ে আমরা এমন সাংবাদিকতাকেই হলুদ সাংবাদিকতা বুঝি, যা পাঠকদের আকৃষ্ট করার জন্য এবং চাঞ্চল্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে অতিরঞ্জিত ও মিথ্যা খবর পরিবেশন করে।

সাংবাদিকতা ও নৈতিকতা একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। কেননা পেশাগতভাবে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় বেশ কিছ নৈতিক ধারণা মেনে চলা হয় : স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সত্য, বস্তুনিষ্ঠতা, সততা, গোপনীয়তা ইত্যাদি। যদি সাংবাদিকতার যথাযথ ভূমিকাকে তথ্য সরবরাহের নিরিখে দেখা হয়, তাহলে নৈতিকতার প্রশ্নটি এভাবে আসে- তা হচ্ছে তথ্যের মান কতটুকু। সংবাদপত্র কেবল মানুষকে তথ্য দেয় না, জনগণকে শিক্ষিত করে, জনচৈতন্য এবং জনমতকে প্রভাবিত করে। আমাদের সংবিধানের আলোকে এদেশ হচ্ছে এমনই এক ভূখণ্ড যেখানে থাকবে বহু মত-পথের ঐতিহ্য, সকল নাগরিকের সমতা, মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সুযোগের নিশ্চয়তা। আর এসবের অবদানে দেশে নিশ্চিত হবে সুশাসন। যে সামাজিক ধারার আবর্তে এবং যেসব ইস্যু এ দেশের জনজীবন ও ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব বিস্তার করে চলেছে সেগুলো স¤পর্কে মানুষের মধ্যে সঠিক ধারণা দেয়া ও সচেতনতা গড়ে তোলার দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের। আর এ কারণেই সংবাদ, সংবাদমাধ্যম সংশ্লিষ্ট সবারই দায়বদ্ধতার সীমাও বাড়ছে বহুগুণে।

লেখক : সংবাদকর্মী

মতামত বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ