নূরুদ্দীন দরজী
বাংলাদেশের খেলাধুলার ইতিহাসে, 'বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট এবং 'বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট' একটি চমকপ্রদ দিক। বিশেষ করে বাংলাদেশের ক্ষুদে ছেলেমেয়েরা ফুটবল খেলায় পারদর্শী হয়ে উঠার জন্য উক্ত টুর্নামেন্ট দুটি দারুন সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছে। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের শুরু হয়েছিল ২০১০ সাল থেকে। বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ যাত্রা আরম্ভ করে ২০১১ সালে।
এর পূর্বে এমন সব আয়োজনের তেমন উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা ছিল না। তবে যতটুকু মনে পড়ে, ২০০৫ অথবা ২০০৭ সালের দিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়াধীন একজন শ্রদ্ধেয় বিভাগীয় উপপরিচালক জনাব মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ আন্তঃপ্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে দুএক বছর আয়োজন হয়েছিল কিন্ত যথেষ্ট সফলতা অর্জন করতে পারেনি। ঐ প্রতিযোগিতা স্থায়ী করতে তিনি উর্ধতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করেন। বঙ্গবন্ধুর নামে ফুটবল টুর্নামেন্ট করার সুপারিশ করলে একটি ভালো দিক বিবেচনা করে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের আলোকে এ টুর্নামেন্ট চালু করা হয।
ছেলেদের পাশাপশি মেয়েদের এগিয়ে নিতে পরের বছর অর্থাৎ ২০১১ সাল থেকে বাংলার মহিয়সী নারী বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে নামকরণ করে মেয়েদের ফুটবল টুর্নামেন্ট ও চালু হয়ে যায়। ইতিপূর্বে ধুমধামের সহিত টুর্নামেন্টের ত্রয়োদশ বছর অতিকান্ত হয়েছে। মাঝে করোনার কারণে দুই বছর প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।
প্রতিযোগিতার পটভূমিতে উল্লেখযোগ্য যে, বঙ্গবন্ধু নিজেই ফুটবল খেলায় যথেষ্ট আগ্রহী ছিলেন এবং ফুটবল খেলতেন। স্কুল জীবনে তিনি গোপালগঞ্জ আঞ্চলিক ফুটবল দলে নাম লেখান। ঢাকায় এসে "ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, এর জার্সি গায়ে অনেক ফুটবল খেলেছেন। একবার বগুড়ায় আয়োজিত একটি খেলায় তিনি অধিনায়কত্ব করে ট্রপি জিতেছিলেন।
বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাই খেলাধুলার প্রতি বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় ছেলে শেখ জামাল ফুটবল খূলতেন। তিনি ঢাকার একটি স্বনামধন্য ফুটবল ক্লাবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু খেলাধুলায় উৎসাহ দিতেন ও সহযোগিতা করতেন।
শিশুদের জন্য দেশে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ চালু হওয়ায় ইতিমধ্যেই খেলাধুলায় আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রারম্ভে অর্থাৎ ভিত্তিমূলে ফুটবল খেলার প্রতিযোগিতা থাকায় ফুটবলে আমাদের ছেলেমেয়েরা ইর্ষান্বিত ফলাফল বয়ে আনছে ।
আমাদের ছেলেরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে খেলায় স্বগৌরবে মেথে উঠে,বাঞ্চিত নৈপুণ্য দেখিয়ে সুন্দর খেলা উপহার দেয়। সবেমাত্র এএফসি কাপের খেলায় তাঁদের পারদর্শিতা দেখে অভিভূত হতে হয়। তুর্কমেনিস্তানের সাথে আমাদের ছেলেদের খেলা দেখে বিশেষভাবে মুগ্ধ হয়েছেন অনেকেই।
বাংলাদেশের মেয়েরা আজ সকল বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে বিশ্ব দরবারে স্থান করে নিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খেলাতে সফল হয়ে অনেক শিরোপাও জিতেছে। ২০২১ সালে নারী ফুটবলে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। ফুটবলে মেয়েরা ভারত, নেপাল ও তাজিকিস্তানকে হারিয়ে শিরোপা ঘরে তুলেছে।
বিগত এক দশকে বাংলাদেশের নারীরা এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ ও ১৬, সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ ও ১৮ এবং বঙ্গমাতা আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপে জয়ী হয়েছেন। মেয়েরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ট্রপি জিতেছে। অনূর্ধ্ব-১৯ ফুটবলে ভারতকে হারিয়েছে।এ ছাড়া কিরকিস্থান, সিংগাপুর, গুয়াম, ইন্দোনেশিয়া ও মালেশিয়া সহ অনেক দেশের সাথে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছে। এ সমস্ত টুর্নামেন্টে জয়ী হওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মেয়েদেরকে বিপুল সংবর্ধনা ও দিয়েছেন। বাংলাদেশের মেয়েরা ফুটবল খেলা থেকে ভালো অংকের উপহার সামগ্ৰী/অর্থ দ্বারা নিজেদের অভাব অনটন ঘুচিয়ে পরিবারে মা বাবাকে ও সহযোগিতা করতে পারে। তাঁরা নিজেরা সাবলম্বী হতে পারছে। সাফল্যর প্রতীক রত্না,সানজিদা, কৃঞ্চারানী,মারিয়া ঐ তহুরারা আজ পরিবারের গর্ব ও ভরসাস্থল এবং দেশের সম্পদ।
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ড প্রায়ই শুরু হয় জুন মাসে। স্কুল পর্যায় থেকে শুরু হয়ে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যারের পর জাতীয় পর্যায়ে ফাইনাল শেষ হতে হতে বছর প্রায় চলে যায়। এ সময় প্রতিটি বিদ্যালয়ে আনন্দের ঢেউ লেগে যায়। ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ খেলা নিয়ে খুবই উৎসাহী, জিতার জন্য আশান্বিত হয়ে যায়। তারা প্রাণপণে খেলে যায়। শিক্ষকগণ তৎপর হয়ে উঠেন। বিশ্বে খেলাধুলায় এত বড় প্লাটফর্ম/প্রতিষ্ঠান/ক্লাব আর কোথাও নাই। এ দুটি সংগঠনের খেলোয়াড় সংখ্যা ২২ লক্ষাধিক। অসংখ্য দর্শক উৎসাহী হয়ে উঠেন শিশুদের খেলা উপভোগ করতে।
আমাদের বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা যেদিন বিশ্বকাপে খেলে বিশ্বকাপ জিতবে সেদিন বোধ হয় আর বেশি দূরে নয়। আমরা চেয়ে আছি তাঁদের দিকে। ঘুমিয়ে আছি শিশুর পিতামাতা সব শিশুদের পরে।
বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেমন চিরঞ্জীব, চিরঞ্জীব মহিয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট চলতে থাকবে দীর্ঘকাল, স্থায়ী হয়ে খেলাধুলায় দেশের সুনাম বয়ে আনবে এ প্রত্যাশায় শেষ করছি।
লেখক: সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)