নূরুদ্দীন দরজী
কিছু দিন আগে নরসিংদী শহরের শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা বই মেলায় গিয়েছিলাম। ঘুরাঘুরির এক পর্যায়ে হঠাৎ দেখা হয় মোঃ শাহিনুর মিয়ার সাথে। শাহিনুর মিয়া পবিত্র কোরআন এর প্রথম বঙ্গানুবাদক ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন এর নামে প্রতিষ্ঠিত "ভাই গিরিশ চন্দ্র সেন গণপাঠাগার,এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
তাঁর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে মধুর আলাপ চারিতার এক সময় চা পানের জন্য পারস্পারিক আহ্বান হয়ে যায়। দ্বৈত সম্মতিতে খানিকটা দূরের এক চা দোকানে আমরা চলে যাই। দোকানে বসে অর্ডারের কিছুক্ষনের মধ্যেই দুই কাপ চা চলে আসে। কথায় মগ্ন থেকে থেকে ও চায়ে চুমুক দিতে থাকি। কেমন যেন ঐ চা একটি আলাদা আমেজ এনে দেয়। বলতে গেলে দারুন শিহরণ জাগায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি পরিতৃপ্তি চলে আসে। এমন সুন্দর চা অন্য কোথাও কোন দিন পান করেছি কিনা ভাবতে থাকি। খুশিতে দুইজনই চায়ের প্রশংসা করতে থাকি।
টাকা পরিশোধ করার মূহুর্তে দোকানিকে ধন্যবাদ দেই। দোকানের এক পাশে দেখতে পাই-"এখানে ৩৪ রকম স্বাদ জাতীয় চা পাওয়া যায়, সম্বলিত একটি চার্ট সাঁটানো আছে। চার্টে ৩৪ প্রকার স্বাদের দ্রব্যের চায়ের নাম ও দাম লেখা রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, দোকানের নাম" মোহাম্মদ আলী ষ্টোর, ঠিকানাঃ নতুন শিল্পকলা একাডেমি রোড, জিরো পয়েন্ট,, বিলাসদী, নরসিংদী। নরসিংদী রেল স্টেশন ছেড়ে আসার সামান্য পশ্চিমে রেল লাইনের নিচে উত্তর পাশে। দেশের শহর বন্দরে এক কাপ চায়ের মূল্য পাচঁ টাকা থেকে শুরু করে নামী দামী দোকানে অনেক হয়। এমন হিসেব চায়ে অভ্যস্ত ব্যক্তি মাত্রই জানেন। এ দোকানে ও প্রকার ভেদে দামের কিছুটা তারতম্য আছে। দোকানির সাথে আলাপ করে দুই একটি ছবি নিয়ে চলে আসতে আসতে চায়ের আদিঅন্ত কিছু চিন্তা মাথায় আসে। ভাবতে থাকি।
মনে পড়ে চা নিয়ে কাব্যরসিকদের কথা। জীবনটাই নাকি এক কাপ চায়ের মত। এক কাপ চায়ে নাকি জীবনের স্বাদ আস্বাদন করা যায়। চায়ের প্রতি চুমুকে হৃদয়ে ঝড় তোলে ভালোবাসার। এ চায়েই খুঁজে পাওয়া যায় বর্ণিল সুখানুভূতি। আবার কেউ বলেন""এক কাপ চায়ে লুকিয়ে থাকে সমুদ্রের গর্জন,পাওয়া যায় জীবনের গল্প,। এ ছাড়া বৃষ্টির দিনে এক কাপ চা ও একটি বই ভালো বন্ধু হতে পারে। সর্বোপরি চায়ের মত জীবন ও তেমন স্বাদ দেয় মানুষ যেমনটি গড়ে তোলে।
যা হোক,আমরা জানি,এ চা নিয়ে রয়েছে অনেক পুরানো ইতিহাস। চা প্রথম উৎপাদন হয়েছিল চীন দেশে। চীনের এক রাজা এক সময় ফরমান জারী করে প্রজাদের চা পানে বাধ্য করেছিলেন। পাক ভারত উপমহাদেশে চায়ের প্রচলন শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে। সম্ভবতঃ আসাম রাজ্যে প্রথম চা উৎপাদন হয়েছিল। পরে এর সূত্র ধরে সিলেটে চাষ আরম্ব হয়। বিট্রিশরা বিতারিত হলে বাংলাদেশে চা চাষে কিছুটা শূন্যতা দেখা দিয়ছিল। আবার পাকিস্তানীরা ও এ শিল্পের হর্তাকর্তা বনে গিয়েছিল।
আমরা ছোট সময় দেখেছি হাটবাজারে বাদ্য বাজনা বাজিয়ে মানুষ জড়ো করে চায়ের ক্যানভাস করা হতো। গান শুনানোর মাঝে মধ্যে কোন একজন চা পাতা দেখিয়ে উপকারিতা বর্ণনা করে চা খেতে অনুরোধ করতেন। কিভাবে খেতে হয় দেখিয়ে দিতো। তাৎক্ষণিকভাবে চা তৈরি করে মানুষকে ফ্রি খাওয়ানো হতো।
আবার বিনামুল্যে চায়ের প্যাকেট মানুষকে দিয়ে দেওয়া হতো। কখনো বা চিনি ও ফ্রি দিয়ে দিতো। ধীরে ধীরে মানুষ চা পান করতে শিখে এবং এক সময় অভ্যস্ত হয়ে যায়। আজ আমাদের চা ব্যতিত এক দিন এমনকি এক মূহুর্ত ও চলে না।
বাংলাদেশ স্বাধীন হলে চা চাষে নতুন মাত্রা পায়। বর্তমানে আমাদের ১৬৭টি চা বাগান রয়েছে। এগুলোর মৌলভীবাজারে ৯১ ,হবিগঞ্জে ২৫,সিলেটে ১৯, চট্রগ্রামে ২১, পঞ্চগড়ে ৮,রাঙামাটিতে ২ ও ঠাকুরগাঁওয়ে ১টি । এ ছাড়া উত্তরবঙ্গে প্রায় পাঁচ শতাধিক ছোট ছোট চা খামার গড়ে উঠেছে। সিলেটের মালনীছড়া চা বাগান পাক ভারতের প্রথম ও বৃহৎ বাগান। এ বাগানের রয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমি। ৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মালনীছড়ার রয়েছে বিশাল গুরুত্ব ।
এ বাগানে জান মালের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এখানে তুমুল যুদ্ধ হয়েছে। বর্তমানে এ দেশে দেড় লক্ষাধিক চা শ্রমিক রয়েছে। এরা চা উৎপাদন, উত্তোলন, বিপননের সাথে জড়িত। এখানে বিশেষভাবে বলতে হয় যে, চায়ের বীজ ও চারার মত চীন থেকে আমাদের দেশে শ্রমিক ও আনা হয়েছিল। এসেছিল ক্রীতদাস টাইপের শ্রমিক যাদের অনেককে জোর করে আনা হয়। উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে শ্রমিকের ঘাটতি মেটাতে ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে ও অপেক্ষাকৃত গরিব শ্রেণির শ্রমিকের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অত্যান্ত দুঃখজনক যে,চা শ্রমিকদের কাজের পারিশ্রমিক নিতান্তই কম। তাদের জীবন খুবই কষ্টদায়ক। তবু বাবা দাদার পেশা ছেড়ে তারা অন্যান্য পেশায় যেতে তেমন আগ্রহী হয়না।
অন্য দিকে চা শ্রমিকদের জীবন রোমাঞ্চকর ও রোমান্টিকতায় ভরা। কাব্য রসিকেরা মনে করেন, চা শ্রমিকদের এমন সৌন্দর্যে ও রোমাঞ্চকর জীবন কাহিনীর সংশ্লিষ্টতার কারণেই চায়ের প্রতিটি চুমুকে জীবনের স্বাদ পাওয়া যায়। চা শ্রমিকদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। আছে নিজেদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি। বিশেষ আকর্ষনীয় তাদের মনোমুগ্ধকর জুমুর নাচ। অনেকে তারের নানাবিধ কাজের জন্য বকশিস প্রদান করতে চায়। গানে গানে তারা বকশিস নয় জীবনের পাওনা চাই। তাদের কাহিনী রচিত হয়েছে পৃথিবীর নানা ভাষায়। নির্মিত হয়েছে অনেক নাটক ও সিনেমা। চা শিল্পের সাথে জড়িত নারী শ্রমিকদের বেশভূষা মানুষের চোখে ও মনে দারুন অনুভুতি সৃষ্টি করে।
এক কালে অনভ্যস্ত এ দেশের মানুষের এখন চা না হলে এক মূহুর্ত ও চলে না। বলা হয় চায়ের কাপে ঝড় তুলে। আমাদের বাংলাদেশ এখন চা উৎপাদন করে, নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিদেশে ও রপ্তানী করে। চা রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে ৮ম স্থান দখল করে আছে। চা শিল্পের উন্নয়ন সহ এর সাথে জড়িত শ্রমিকদের জীবন মানের অবশ্যই উন্নতি করতে হবে। অতীতের সকল গ্লানির অবসান করে চা শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে। চা শিল্প হবে আমাদের উন্ননের সোপান।
নরসিংদীর"মোহাম্মদ আলী স্টোর'র মত বাংলাদেশের আনাচে কানাচে চায়ের সুরভিতে ভরে উঠবে সকল স্টল-এ প্রত্যাশায় শেষ করছি।
লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)