মো. শাহাদাৎ হোসেন রাজু: প্রাচীনকাল থেকে কলা চাষে বেশ নাম-ডাক রয়েছে নরসিংদী জেলার। এ জেলার উৎপাদিত অমৃত সাগরের খ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে সেই অমৃতসাগর। তাই বলে থেমে যায়নি নরসিংদীর কলা চাষ। এখনো হরেক রকমের কলা চাষ হয় এই জেলায়।
আর এই কলা বিপণনের জন্য জেলার বিভিন্ন উপজেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি কলার হাট। তাদের মধ্যে মনোরদী উপজেলার হাতিরদিয়া বাজার, চালাকচর বাজার ও পুলেরঘাট বাজার, বেলাব উপজেলার বেলাব বাজার, পুরাইন্দা বাজার ও জঙ্গি শিবপুর বাজার, পলাশ উপজেলার কালিরহাট, চরণগদ্ধি বাজার, ও তালতলী বাজার কলার হাট অন্যতম।
নরসিংদী জেলার কলার হাটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরানো ও ঐতিহ্যবাহী বেলাব বাজার কলার হাট। প্রায় পাঁচশ বছরের পুরাতন এই হাট বসে প্রতি শুক্রবার ভোর বেলায়। এক সময় বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে শুরু হয়ে শুক্রবার বেলা গড়ানো পর্যন্ত চলতো এই হাট। কিন্তু বর্তমানে শুক্রবার ভোর থেকে বেলা ১১ টা পর্যন্ত চলে হাটের কেনা-বেচা। প্রতি হাটে বিক্রি হয় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার কলা। এ অঞ্চলের কলার সুনাম থাকায় এবং খাজনা নিয়ে কোন দর কষাকষি না থাকায় পাশাপাশি যাতায়ত ব্যবস্থা সহজতর হওয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা এসে এখান থেকে কলা কিনে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে হাটটি তার জৌলশ হারালেও তা ফিরিয়ে আনার চেষ্ট করছেন বাজার কমিটি।
কাক ডাকা ভোর থেকে রিকশা ও ভ্যানে করে সাগর, চিনি চম্পা, সবরি, গেরা সুন্দর, গুটি ও সুমাই কলাসহ বিভিন্ন জাতের কলা এনে সারি সারি করে সাজিয়ে রাখা হয় হাটটিতে। এরপর বেপারিদের সাথে দর-কষাকষি করে কলা কেনাবেচা করতে হয় কৃষক ও ব্যাপারীদের। জাত ও আকার ভেদে এই হাটে কলার প্রতি কাঁদি বিক্রি হয় ৩ শ’ থেকে ১২শ’ টাকা পর্যন্ত। সকাল ৭টা থেকে বেলা সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এই হাটে চলে কেনাবেচা । প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টার এই হাটে বিক্রি প্রায় ৪ থেকে ৫ লাখ টাকার কলা।
হাটে আসা কলা ব্যাপারী জানায়, তাদের পূর্বপুরুষদের আমল থেকে বেলাব বাজার কলার এই হাটে কলা বিক্রি করে আসছে তারা। দূর-দূরান্ত থেকে হাটে পাইকাররা কলা কিনতে আসায় ব্যাপারী ও কৃষকরা দামও পাচ্ছে ভালো। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী এই কলার হাটটিতে হাজারো ক্রেতা-বিক্রেতার সমাগম হলেও বেলাব বাজারের বিগত বাজার কমিটির কিছু অব্যবস্থাপনায় হাটের জায়গা সংকুলান না থাকায় ভোগান্তিতে পড়তে হয় অনেককেই। হাটটির ঐতিহ্য ধরে রাখতে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নতসহ হাটের আকার বাড়ানোর দাবি ব্যাপারী, কৃষক ও পাইকারদের।
কলা ব্যাপারী হজরত আলী বলেন, বেলাব উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষকের ক্ষেত থেকে কলা কিনে আমি এ বাজারে প্রায় ৩০ বছর যাবত কলার ব্যবসা করে যাচ্ছি। সারা বছরজুড়ে কলা পাওয়া যায়। তাই বাপ দাদার আমল থেকে আমরা এই ব্যবসা করে যাচ্ছি।
বেলাব বাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো থাকায় দেশের যেকোন স্থান থেকে অতি সহজে এ বাজারে কলা কিনতে আসতে পারে পাইকাররা।
কলা কিনতে হাটে আসা মোশারফ হোসেন নামে এক পাইকার জানান, তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে এই হাটে কলা কিনতে এসেছেন। প্রতি সপ্তাহে তিনি এখান থেকে কলা কিনে ঢাকার বিভিন্ন আড়তে বিক্রি করেন। হাটের পাশে সড়কটি প্রশস্ত হলে যাতায়াতে অনেকটা সুবিধা হতো।
চরবেলাব এলাকার পাইকার আবদুর রশিদ জানান, তিনি এ হাট থেকে কলা কিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন আড়তে আড়তে কলা বিক্রি করে থাকেন। এ এলাকার কলা আকার এবং সাইজ ভাল হওয়ার আড়তগুলো এর চাহিদা বেশী থাকায় প্রতি শুক্রবার বেলাব বাজার কলার হাটের তিনি কলা কিনতে আসেন। পাশাপাশি অন্যান্য হাট থেকেও পাশ্ববর্তী পুরাইন্দা হাট থেকেও কলা কিনে থাকেন।
ঐতিহ্যবাহী বেলাব বাজার কলার হাটের পুরোন সেই ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছেন বাজার কমিটি বলে জানান,
বেলাব বাজার কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওলিউর ভূঁইয়া বেদন। তিনি বিগত কমিটির কিছু অব্যবস্থাপনায় এই হাট ঐতিহ্য হারালেও তা পূণরায় ফিরিয়ে আনার জন্যে আমরা ইতোমধ্যে হাট প্রস্থ করনের জন্য বালুভরাটে উদ্যোগ হাতে নিয়েছি। শুধু তাই নয় হাটের সৌন্দর্যবর্ধনে আমরা উদ্যোগ গ্রহন করেছি।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ বছর নরসিংদীতে ২ হাজার ৩শ’ হেক্টর জমিতে কলার আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় জেলার বিখ্যাত অমৃত সাগর কলা। জেলার ছয়টি উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কলার আবাদ হয় মনোহরদী, শিবপুর ও পলাশ উপজেলায়। এ অঞ্চলের কলা বিষমুক্ত ও সুস্বাদু হওয়ায় চাহিদা রয়েছে অনেক। এখান থেকে বেপারিরা কলা কিনে নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করে।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো মাহবুবুর রশিদ জানান, ঐতিহ্যবাহী এই হাট ছাড়াও জেলায় ছোটবড় আরও বেশ কয়েকটি কলার হাট রয়েছে। যেখানে বিক্রি হয় জেলার বিখ্যাত অমৃত সাগরসহ বিভিন্ন জাতের কলা। জেলার কলার আবাদ বাড়াতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ ও সহযোগিতা করা হচ্ছে।