স্টাফরিপোর্টার: আন্ত:বিভাগে অতিরিক্ত রোগী ভর্তি দেখিয়ে অর্থআত্মসাৎনার্সসহ স্টাফরা কথামত কাজ না করলে বদলীর হুমকি, দরপত্র বাছাইয়েপক্ষপাতিত্বসহ অসংখ্য অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে নরসিংদীর রায়পুরা ৫০ শয্যা বিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. খান নূরউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে। উপজেলার স্বাস্থ্য বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদটিতে যোগদানের পর থেকেই অদৃশ্য ক্ষমতার বলে প্রতিনিয়ত তিনি এসব অনিয়ম চালিয়ে গেলেও নিরব ভূমিকায় সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ফলে সচেতন মহলে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
জানা যায়, ২৪টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ উপজেলা রায়পুরা। এখানে প্রায় ৭ লাখ মানুষের বসবাস।আর এ সাত লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে রয়েছে একটি মাত্র উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স।
বিভিন্ন সূত্রে ও সরজমিনে জানা যায়, গত ১৯ জানুয়ারি২০২২ইং তারিখে অত্র উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা হিসেবে যোগদান করেন ডাঃ খান নূরউদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর। উপজেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ পদের এই কর্মকর্তার কর্মস্থল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সকলে কাজে তদারকি হস্তক্ষেপ করতে পারেন। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের পর থেকে অদ্যাবদি তিনি প্রতিদিন ১১টার পরে অফিসে আসেন। কোন বিশেষ কারণ ছাড়া এর আগে তাকে কার্যালয়ে আসতে দেখা যায় না। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. খাঁন নূর উদ্দিন মো. জাহাঙ্গীর একজন সার্জন হওয়ার সুবাদে অনেক প্রসূতিসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন যাদের অপারেশ জরুরি সেই সব রোগী তার স্মরণাপন্ন হলে তিনি তাদেরকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা না দিয়ে বরং ভৈরবে তার নিজস্ব ক্লিনিকে যাবার পরামর্শ দেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে।
গত ৮ অক্টোবর ২০২২ইং তারিখে প্রকাশিত দরপত্রের মাধ্যমে আন্ত:বিভাগে ভর্তিকৃত রোগীদের খাদ্য ও পথ্য সরবরাহের লক্ষে ঠিকাদার মনোনীত করেন। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তিনটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিলেও একটি প্রতিষ্ঠানের দরপত্র বাতিল হয়। বাকী দুটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে খান এন্টারপ্রাইজ সর্বনিম্ন দরদাতা দরপত্র দাখিল করলেও ওই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তার স্বার্থসিদ্ধির জন্য সেই নিয়ম-নীতিকে তোয়াক্কা না করে তার পছন্দের ঠিকাদারী প্রতিষ্টান সর্বোচ্চ দরদাতা আসফিক মেটালকে কার্যাদেশ প্রদান করেন।
সেই থেকে অদ্যবাদি প্রতিদিন আন্ত:বিভাগে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা কখনো দিগুন আবার কখনো তিনগুণ বাড়িয়েএসব অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাৎ করছেন।মধ্য রাত হলেই অতিরিক্ত রোগীর তালিকা প্রস্তুতির কাজশুরু হয় প্রতিদিন রোগীদের জন্য দুইটি তালিকা তৈরি করা হয়।একটি খাবার তালিকা এবং আরেকটি বিল তৈরির তালিকা। প্রতি রোগীর খাবার সরবরাহের জন্য প্রতিদিন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান পায় ১৭৫টাকা।প্রতিদিন ভর্তি তালিকার চেয়ে বিল তৈরির তালিকায় ১০/১২/১৫ জন অতিরিক্ত দেখিয়ে মাসে ৫০/৭০ হাজার টাকা অতিরিক্ত হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এই টাকার পুরোটাই ঢুকছে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পকেটে।এসব অনিয়মে দায়িত্বরত নার্সরা কখনো আপত্তি জানালে তাদেরকে দায়িত্ব দেন অন্যত্র।
এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে এ প্রতিবেদক বিগত এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে রোগী ভর্তি ও রেজিষ্টারখাতায় রোগী অন্তর্ভুক্তির একটি তালিকা সংগ্রহ করে তালিকায় দেখা যায় প্রতিদিনই রোগী ভর্তির তুলনায় ১২/২০ জন রোগী অতিরিক্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সোমবার (১২ জুন) সকাল আটটার সময় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় হাসপাতালে পুরুষ, মহিলা ও লেবার ওয়ার্ডে মোট ২৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে।কিন্তু হাসপাতালে রোগী ভর্তি রেজিষ্ট্রার দেখতে চাইলে সেখানে দায়িত্বরত নার্সরা তা দেখাতে অস্বীকৃতি জানায়।পরে একপর্যায়ে তারা তা দেখাতে বাধ্য হয়। রেজিষ্টার খুলে সেখানে দেখা যায় ভর্তির তুলনায় ১৪ জন রোগীর নাম অতিরিক্ত লেখা আছে। অর্থাৎ রেজিষ্টারে ৪০ জন রোগী ভর্তি দেখানো হয়েছে। বিষয়টি তাদের কাছে জানতে চাইলে এব্যাপারে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সাথে কথা বলতে বলে তারা।
এছাড়াও বাড়িতে ডেলিভারি হয়েছে এমন অনেকের নাম লেবার ওয়ার্ডে ভতি দেখিয়ে রেজিষ্ট্রারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরে সেই সকল রোগিদের খুঁজে বের করে তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ডেলিভারি কিছুদিন আগে ওই সকল প্রসূতিরা তাদের শারিরীক অবস্থার চেকআপ করাতে আসলে চিকিৎসক আল্ট্রাসনোগ্রামসহ অন্যান্য রিপোর্টের কাগজপত্র দেখে তাদের পেটে থাকা বাচ্চার পজিশন এবং ওজন স্বাভাবিক আছে এবং সেই সাথে নরমাল ডেরিভারি হওয়ার সম্ভাবনার কথার জানায়। সেই কারণে বাচ্চা ডেলিভারির দিন প্রসব ব্যাথা উঠলেও তাদের বাড়িতে রেখেই ডেলিভারি করানো হয়। এখানে উল্লেখ্য যে প্রতিটি প্রসূতির নরমান ডেলিভারির ক্ষেত্রে ওষদ ও বাচ্চা রেকসিন বাবদ সরকারের ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ৭ শ’ টাকা। তাছাড়া খাবার খরচতো আছেই। জানা যায়, আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে প্রসূতিদের সম্ভাব্য ডেলিভারি যে তারিখ দেয়া থাকে সেই দিনই হাসপাতালে ওই প্রসূতির ভর্তি দেখানো হয়। এছাড়াও অত্র উপজেলা কমপ্লেক্সে সম্প্রতি ‘স্বাস্থ্য সেবা বন্ধ রেখে পিঠা উৎসব ” এমন একটি সংবাদ বিভিন্ন পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হলে ব্যাপক সমালোচিত হয়।
মুক্তা বেগম নামে উপজেলার পলাশতলী ইউনিয়নের সাওরাতলী এলাকার প্রসূতি মাকে খুঁজে বের করে তার সাথে কথা বললে তিনি জানান, গত ৯ মে তিনি একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। কোন রকম সমস্যা ছাড়াই বাড়িতেই এক নার্সের সহযোগীতায় স্বাভাবিক ভাবে তার সন্তান প্রসব হয়। এর জন্য তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। অথচ আশ্চার্চের বিষয় ওই তারিখে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রেজিষ্ট্রারে প্রসূতির মুক্তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা আছে।
পরে খাদ্য ও পথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আসফিক মেটালের স্বত্তাধিকারী নয়ন মিয়ার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে খাদ্য সামগ্রী সরবরাহের জন্য আমি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মূলফটকে অবস্থিত এমদাদ ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের মালিক শফিকুল ইসলাম শফিককে সাব কন্ট্রাক দিয়েছি, তিনি বিষয়টি বলতে পারবেন।
খাদ্য ও পথ্য সরবরাহের দায়িত্বে থাকা শফিকুল ইসলাম শফিকের সাথে কথা বললে তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তার প্রসংশায় পঞ্চমুখ থেকে বলেন, স্যার আসার পর এখানে রোগির সংখ্যা অনেক বেড়েছে। তার এ কথায়, তেমনটাই তো দেখলাম ২৬ জনের জায়গায় রেজিষ্ট্রারে এন্ট্রি আছে ৪০ জন রোগির নাম, প্রতিবেদকের এমনটা বলে উঠলে তিনি হকচকিয়ে যান। সকালে কতজনের নাস্তা দিয়েছেন। উত্তরে তিনি বলেন, ৩১ জনের। ২৬ জনের স্থলে ৩১ জনের নাস্তা কেন দেয়া হলো পাল্টা প্রশ্নে তিনি কোন সদুত্তোর দিতে পারেনি।
আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আর.এম.ও) ডা. মাসুদুজ্জামান’র কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি সবেমাত্র এখানে জয়েন করেছি।তাই এসব বিষয়ে কিছু বলতে পারছি না।তবে ঘটনা যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে সত্যিই দুঃখ্যজনক।
এ ব্যাপারে রায়পুরা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. খাঁন নূর উদ্দিন মো. জাহাঙ্গীর’র কাছে জানতে চাইলে তিনি অতিরিক্ত রোগী ভর্তি দেখানোর বিষয়ে তিনি কিছুই জানেনা বলে জানান। পরে কথার ঘোর পাল্টে এর সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আমাদের এখানে সরকারি বেতন বহির্ভূত আটজন কর্মচারী নিয়োজিত রয়েছেন।প্রতিমাসে তাদের পেছনে ৩০/৩৫ হাজার টাকা ব্যায় হয়।আর এ টাকাগুলো আমাকে ম্যানেজ করতে হয়।তাদের বেতনের টাকা সংগ্রহ করতে গিয়ে আমাকে এখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক, সেবিকা ও বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানীগুলোর দ্বারস্থ হতে হয় ।এব্যাপারে ডিজি মহোদয়ের সাথে আলাপ করলে তিনি রোগীদের ডায়েট থেকে কিছু অতিরিক্ত টাকা সংগ্রহ করাযায় কিনা সে ব্যাপারে পরামর্শ দেন।তাই প্রতিদিন দুই চারজন অতিরিক্ত দেখানো হয়।ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখা হবে বলেও জানান তিনি।
কোন অপরেশনের রোগ আসলে তাদেরকে ওেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সেবা না দিয়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা তার নিজস্ব ক্লিনিকে যাবার পরামর্শের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আসলে রাতের বেলায় কোথাও কোন ডাক্তার না পেয়ে যারা সমস্যায় পড়তে পারে আমি তাদেরকেই সেখানে যেতে বলি।
নরসিংদী সিভিল সার্জন ডা. মো. নূরুল ইসলাম বলেন, আন্ত:বিভাগে অতিরিক্ত রোগি ভর্তি দেখানোর কোন সুযোগ নাই। তারপরেও যেহেতেু এব্যাপারে কথা উঠেছে তাই আমি বিষয় ক্ষতিয়ে দেখব। আর বাড়িতে ডেলিভারি হয়েছে এমন প্রসূতি মায়ের নাম হাসপাতালের রেজিষ্ট্রারে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। বিষয়টা আমি শক্ত হাতে হ্যান্ডেল করবো। সর্বোচ্চ দরদাতাকে দরপত্রের কার্যাদেশ দেয়ার বিষয়টা আমার জানা নেই। এ বিষয়ে আমি উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা কথা বলবো। আর পিঠা উৎসবের বিষয়টা আমি অবগত আছি। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি ওই দিন অনুষ্ঠানের রায়পুরার ইউএনও সাহেব উপস্থিত ছিলেন। সকাল ৯টার দিয়ে আলাদা একটা রুমের ভিতর অনুষ্ঠানটি করা হয়।
জাগোনরসিংদী টুয়েন্টিফোর ডটকম/শহজু