মো.শাহাদাৎ হোসেন রাজু: নরসিংদীতে বেশ কয়েক বছর ধরেই বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে লটকন। ব্যাপক লাভজনক হওয়ায় দিন দিন লটকন চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন অনেকে। স্থানীয়ভাবে এ ফলটি ‘বুগি’ নামে পরিচিত। লটকন বৃক্ষ মাঝারি আকারের এবং চির সবুজ। ফল গোলাকার, ফল পাকলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে। বর্তমানে এই ফলটি দেশের গন্ডি পেরিয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
লটকন অত্যন্ত পুষ্টিকর, সুস্বাদু ও ভিটামিন বি-২ সমৃদ্ধ একটি ফল। এই ফলে চর্বি অত্যন্ত কম। তাছাড়া এ ফলে কোন শর্করা না থাকায় সকল বয়সের মানুষ কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়।সুস্বাদু টক-মিষ্টি লটকনের কথা এলেই নরসিংদীর নামটা চলে আসে সবার আগে। কারণ এ অঞ্চলের লটকন অন্য যে কোনো জেলার উৎপাদিত লটকনের চেয়ে তুলনামূলক ভাবে মিষ্টি এবং রসালো হয়।
এখানকার বেলে ও দো-আঁশ মাটিতে ফলটির ফলন ভালো হয়। সেজন্য এ জেলার মানুষজন লটকনের চাষ বাণিজ্যিক ভাবে করছেন।প্রতিবছরই বাড়ছে লটকন চাষের সংখ্যা ও এর উৎপাদন। আর্থিকভাবে বেশ লাভবানও হচ্ছেন এ জেলার চাষিরা। লটকন চাষ করে ভাগ্যবদল হয়েছে হাজারো কৃষকের। বিগত বছরে তুলনায় এবছর খুব একটা ভাল ফলন হয়নি। মওসুমের শুরুতেই গাছে গাছে ছত্রাকে আক্রান্ত হয় লটকন ফল। ফলে অন্যান্য বছরের তুলনা এ বছর ফলন কম হয়। তবে সারাদেশে লটকনের ব্যাপক চাহিদা থাকায় এবছর দাম ভাল পাচ্ছেন বাগান ক্রয়করা লটকনের পাইকারী ব্যবসায়ীরা।
গত দুই বছর মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দেশে চলমান লকডাউনের ফলে লোকসান গুনা বাগান খরিদ করা পাইকারী ব্যবসায়ীরা এবার তাদের সেই ক্ষতি পুষিয়ে লাভের মুখ দেখবেন বলে আশা করছেন অনেকেই।
স্থানীয়দের কাছে এ ফলটিকে ‘বুগি’ নামে বেশি পরিচিত। গাছটির কাণ্ড থেকে বের হওয়া এ লটকনের থরে থরে ঝুলে থাকার দৃশ্য যে কারোরই নজর কাড়বে। বর্ষায় ভিজে থাকা প্রকৃতিতে এ দৃশ্য আরও বেশি ফুটে ওঠে। অপ্রচলিত এ ফলটি একসময় পুষ্টিকর ফল হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং নরসিংদীর মানুষের অর্থকরী ফসলে পরিণত হয়।
প্রায় একশ বিশ বছর পূর্বে শিবপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের আজকিতলা গ্রামে লটকন চাষের গোড়াপতন করেন মরহুম হাজী আব্দুল আজিজ। তিনিই এ অঞ্চলে প্রথম লটকন চাষ শুরু করেন। লটকন চাষের জন্য তিনি বেশ কয়েকবার চ্যানেল আই কৃষি পুরস্কার লাভ করেছেন।
তার এই লটকন চাষে উদ্বুদ্ধ হয়ে শিবপুর ও বেলাব উপজেলার লাল মাটি অধূষ্যিত কয়েকটি ইউনিয়নে লটকন চাষের প্রসার ঘটতে থাকে। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে খাদ্য ও পুষ্টি গুণ সমৃদ্ধ লটকনের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে ব্যাপক চাহিদা ও লাভজনক হওয়ায় প্রতিবছরই লটকনের চাষ বাড়তে থাকে। এই দুই উপজেলায় প্রায় প্রতিটি পরিবারের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি এখন লটকন। লটকন চাষ করে ভাগ্যের চাকা ঘোরানোর পাশাপাশি বেকার সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পেয়েছে অনেকে।
পুষ্টিবিদদের মতে, মানুষের শরীরে একদিনে যে পরিমাণ ভিটামিন ‘সি’ প্রয়োজন মাত্র তিন থেকে চারটি লটকন সে চাহিদা মেটাতে পারে। ছোট এ ফলটি ভিটামিন ‘বি-টু’, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহসহ বিভিন্ন খনিজ উপাদানে ভরপুর। যা করোনাকালে আমাদের সবার শরীরের জন্য খুবই উপকারী।
লটকন গাছ সাধারণত বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে রোপণের উপযুক্ত সময়। বর্ষার শেষের দিকে অর্থাৎ ভাদ্র-আশ্বিন মাসেও গাছ লাগানো যায়। লটকনের গাছ লাল মাটিতে ঝোপের মতো হয়ে থাকে। প্রতিবছর মাঘ-ফাল্গুনে লটকন গাছে মুকুল আসা শুরু হয়। জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে এ ফল পরিপক্কতা পায়। এটি চাষে তেমন কোনো খরচ নেই। স্ত্রী গাছ লাগিয়ে দিলেই হয়। সময়ে সময়ে একটু পরিচর্যা করতে হয়। গোড়ার চারদিকে জৈব সার দিলে ফলন ভালো হবে। পিঁপড়া বা পোকামাকড়ের হাত থেকে ফল বাঁচাতে ছত্রাকনাশক ওষুধ দিতে হয়।
নরসিংদী জেলা কৃষি অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলার শিবপুর, বেলাব ও রায়পুরা উপজেলার লাল মাটিতে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান, তাই এখানে লটকনের ভালো ফলন হয়। চলতি মৌসুমে ১ হাজার ৬৭৩ হেক্টর জমিতে লটনকনের বাগান করা হয়েছে। যা হেক্টর প্রতি ১৫ টন হারে ২৫ হাজার ৯৫ মেট্রিক টন (এক টন সমান ১০১৬ কেজি) লটকনের ফলন পাওয়া যাবে বলে আশাবাদী কৃষি বিভাগ। আর উৎপাদিত এ লটকন পাইকারি ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। যার মূল্য পাওয়া যাবে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা।
কৃষি অধিদপ্তর জানায়, রোপণের তিন বছরের মধ্যে লটকন গাছে ফলন আসে। প্রতিটি গাছ ফল দেয় টানা ২০ থেকে ৩০ বছর। লটকন গাছের রোগবালাই তেমন দেখা যায় না। ফল সংগ্রহের ৬০ দিন আগে গাছ প্রতি ৫০ গ্রাম পটাশ পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছের গোড়ায় দিলে ফলের মিষ্টতা ও আকার বৃদ্ধি পায়।
এ ফল চাষের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো বিক্রির জন্য কোন টেনশন করতে হয় না। পাইকারী ব্যবসায়ীরা লটকন কাঁচা থাকা অবস্থায় চাষিদের কাছ থেকে বাগান খরিদ করে নেয়। বাগান খরিদের পদ্ধতিতে রয়েছে ভিন্নতা। প্রথমে বাগানের মালিকের কাছ থেকে একদল পাইকার দাম-দর করে বাগান ক্রয় করেন, পরে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পাকা লটকন বাগান থেকে সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করেন। প্রকারভেদে পাইকারি মণ প্রতি দাম ওঠে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। যা খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।
জানা যায়, ২০০৮ সাল থেকে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে নরসিংদীর সু-স্বাদু এ লটকন ফল। কিন্তু এ বছর মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে দেশের বাইরে রপ্তানি করার সম্ভব হবে কি তা নিয়ে সংশয় রয়েছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা মাঝে।
এদিকে মৌসুমী এ ফলের বেচাকেনাকে ঘিরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের রায়পুরার মরজাল, বেলাবরের বারৈচা, পলাশের রাবান ও শিবপুর উপজেলা সদরে ও যোশরে বসছে লটকনের পাইকারী বাজার।
প্রতিদিন সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলার পাইকারি ক্রেতারা এসে এসব বাজার থেকে কিনে নিয়ে যায় লটকন। পর্যায়ক্রমে হাত বদল হয়ে লটকন যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলার বাজারে। অনেকে সরাসরি বাগান থেকে লটকন কিনে সরবরাহ করছেন।
শিবপুর উপজেলার জয়নাগর ইউনিয়নের আজকিতলা গ্রামের লোকমান হায়দার বলেন, কম খরচে লাভজনক ফসলের মধ্যে লটকন একমাত্র । লটকন বাগান শুরু করতে প্রথমে খরচ বেশি পড়লেও পরবর্তি সময়ে বিঘা প্রতি ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয় না। সে তুলনায় লাভ বেশি হয়। এছাড়া লটকন ফলের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে গাছের কাণ্ডে ফল ধরে। কখনও কখনও এত বেশি ফল আসে যে গাছের ডাল পর্যন্ত দেখা যায় না। একটি পূর্ণবয়স্ক লটকন গাছে ৫ থেকে ১০ মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
এবছর তার বাবা মরহুম হাজী আব্দুল আজিজের হাতে গড়ে তোলা (পরবর্তীতে তাদের ৪ ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া হয়েছে) লটকন বাগান বিক্রি হয়েছে ৮০ লাখ টাকা।
তিনি আরও বলেন, এ বছর আশানুরোপ ফলন পাওয়া যায়নি। মৌসুমের শুরুতে গাছগুলো ছত্রাকে আক্রান্ত হয়। স্থানীয় কৃষি বিভাগের লোকজন মাঝে মধ্যে আসলেও বাগান পরিচর্চায় তাদের তেমন কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হয় না।
বেলাব উপজেলার লাখপুর গ্রামের বাগান মালিক মানিক মোল্লা জানান, লটকন ফল বিক্রির ভাবনা ভাবতে হচ্ছে না তাদের। স্থানীয় বাজার ছাড়াও লটকনের ফল ধরার পর বাগান বিক্রি করে দেওয়া যায়। পাইকাররা বাগান থেকেই লটকন কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি দুই একর জমিতে লটকন বাগান করেছেন। এ বছর একটি লটকন বাগান ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা এবং আরেকটি বাগান ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায় পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন।
বাগান খরিদ করা পাইকারী ব্যবসায়ী হারিছ মিয়া বলেন, গত দুই বছর লটকনের বাগান কিনে অনেক টাকা লোকসান দিয়েছি। এবছর আমি ধার-দেনা করে ৭ লাখ টাকায় ৩ টি বাগান কিনেছি। এবছর আমরা লটকনের ভাল দাম পেয়েছি। এরই মধ্যে আমি আমার আসল টাকা তুলতে পেরেছি। লটকনের মৌসুম প্রায় শেষের দিকে। সবকিছু মিলিয়ে এ বছর গত দুই বছরের লোকসান অনেকটা পুষিয়ে নিতে পারবো।
বাগান থেকে লটকন কিনতে আসা ফরিদ হোসেন নামে অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, এ বছর আমরা লটকনের বেশ ভাল দাম পাচ্ছি। মৌসুমের শুরু থেকে সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা মন ধরে বিক্রি হচ্ছে।
নরসিংদী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. ছাইদুর রহমান বলেন, 'লটকন চাষ বৃদ্ধিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চারা উৎপাদন করাসহ কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।কৃষকরা এ ফল বিক্রি করে বেশ লাভবান হচ্ছেন।'