নূরুদ্দীন দরজী
আমার দুই খন্ড জমি এবার তেভাগায় বর্গা দিয়েছি। আমাদের গ্ৰামের মাহফুজ এবং আফছারউদ্দীন বর্গা নিয়েছেন। তাঁদের অনেক বলেছি, অর্ধেক ফসল আমাকে দিতে। আফছারউদ্দীনকে বললাম,"আমার নানার নাম ও আফছারউদ্দীন ছিল, আপনি আমার নানার মতই ,ইচ্ছে করলে আমাকে অর্ধেক দিতে পারেন,! হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন," জমি চাষে এখন অনেক খরচ,।
হাল বাওয়া থেকে শুরু করে,জালা তৈরি ও রোপন,সার, কীটনাশক,সেচের পানির ভাড়া ও কামলা বাবদই অনেক টাকা চলে যায়। নিজের খাটুনি বাদ দিয়ে ও ধান কাটা,পরিবহন ও মাড়াইয়ের পর হিসেব করলে কিছুই থাকেনা। প্রতি কানি জমিতে গড় খরচ আসে দশ হাজার টাকার ও বেশি। কানি প্রতি যদি পঁচিশ মণ ধান হয় আর তার অর্ধেক জমির মালিককে দিলে খরচ বাদ দিয়ে চাষীর কি থাকে ? এর উত্তর আমার কাছে জানতে চান তিনি । হিসেব মিলাতে পারছিলাম না বলে কথা আর বাড়াইনি। তাদের প্রস্তাবেই রাজি হয়ে আমি আমার বাড়ির পথ ধরি।
বাড়ি ফেরার পথে পথে চাষীদের নানাবিধ কষ্ট ও সংগ্ৰামের কথা মনে পড়ছিল। ন্যায্য ফসলের দাবীতে এ দেশে তাঁদের অনেক রক্ত ও ঝরেছে। বৃটিশ রাজত্বের শেষ দিকে ১৯৪৬ সালে চাষীরা রক্তক্ষয়ী "তেভাগা,, আন্দোলনে নেমেছিলেন। অবিভক্ত দিনাজপুরে এ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। বর্গা চাষীদের দাবী ছিল," জমির উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ চাই,,। ঐ আন্দোলনের প্রধান নেতৃত্বে ছিলেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ। ইলামিত্র, গুরুদাস তালুকদার ও বিষ্টু মাঝিসহ অনেকেই চাষীদের দাবীর সমর্থনে কাজ করেছেন।
বাংলাদেশের দিনাজপুর,ঠাকুরগাঁও, রানীশংকৈল, বিরল,চিরিরবন্দর, ফুলবাড়ী, খাঁপুর,বিরামপুর সহ অনেক জায়গায় "তেভাগা,,আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়েছিল। ওপার বাংলার জলপাইগুড়িসহ আন্দোলনটি কলকাতায় বিস্তার ঘটে। স্থায়ী হয়েছিল প্রায় এক বছর। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল রংপুর এবং সাথে শক্ত ঘাঁটি ছিল দিনাজপুরে । তখন অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। জনাব সোহরাওয়ার্দী নীতিগতভাবে" তেভাগা'র দাবী পূরণের আশ্বাস দিলে আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়েছিলয় বলে জানা যায়। তখন সব চেয়ে বড় কাজ ছিল ভারত থেকে ইংরেজ তাড়ানো।
১৯৪৭-এ বৃটিশরা চলে গিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলেও ঐ আন্দোলনের ফসল চাষীরা ঘরে তুলতে পারেনি। আজ অবধি তাদের দাবী কত ভাগ সফল হয়েছে বলা দূরহ।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে,এক সময় জমি চাষ করে চাষীদের ফসল তুলতে হতো জমির মালিকের উঠানে। মালিক নিজেদের সন্তোষ্টি অনুযায়ী চাষীকে অর্ধেক ফসল দিতো। এ দেশে বিশেষ করে ইংরেজদের দুঃশাসনের সময় জমিদারী প্রথার চরম মূহুর্ত। জমিদাররা ইংরেজ প্রভুদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য উচ্চ হারে খাজনা দিতো। আর এর পেরেশানিতে চাপ পড়তো জমি চাষ ও চাষীর উপর। এমন অবস্থায় চাষীরা অনেক ক্ষেত্র যথা সময়ে জমির খাজনা দিতে ব্যর্থ হতেন। এমন হলে জমিদারদের হয়রানিতে পড়ে চাষীরা নিলাম ইত্যাদির শিকার হয়ে জমির উপর নিজেদের মালিকানা হারিয়ে নিঃশ্ব হয়ে পড়েতো। নিজের জমি হারিয়ে বর্গা জমি চাষ করা ছাড়া তাদের কোন পথ থাকতো না । অন্যের জমি চাষ করে মোটেও পোষাতো না বলে বেঁচে থাকার তাগিদে আন্দোলন মুখী হয়েছিলেন।
এ আন্দোলন চতুরদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। অনেক জায়গায় "তেভাগা,, আন্দোলন ব্যাপকতর হলে দিনাজপুর সংলগ্ন খাঁপুরে সহিংস রুপ নিয়েছিল। সেখানে কৃষক চাষীদের সাথে বৃটিশ সেনা মিশ্রিত গুর্খা ও অন্যান্য সেনার সাথে তুমুল সংঘর্ষ হয়েছিল। অনেক চাষী তাদের মূল্যবান জীবন বিসর্জন দিয়ে শহীদ হন। খাঁপুরে একদিনের ব্যাপক সংঘর্ষে ২৬ জন চাষী শহীদ হয়েছিলেন। ঐ শহীদগণের স্মরণে বর্তমান পশ্চিম বাংলার খাঁপুরে এখনো দাঁড়িয়ে আছে একটি স্মৃতিসৌধ- যেখানো লেখা রয়েছে- "এঁদের মৃত্যু নেই-এঁরা মৃত্যুঞ্জয়ী,,।
আমাদের বাংলাদেশের গর্বিত সন্তান হাজী মোহাম্মদ দানেশ বর্গা চাষীদের "তেভাগা,,আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে যেয়ে অনেক নির্যাতন সহ্য করেছেন। তাঁকে বেনিয়া বৃটিশরা গ্ৰেফতার করেছিল। হাজী মোহাম্মদ দানেশের গ্ৰেফতারের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে সেদিন দিনাজপুর শহর লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়েছিল। দিনাজপুরে তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে, গেলে " তেভাগা,, আন্দোলনে এ মহতীর কথা মনে করিয়ে দেয়। তিনি কিংবদন্তি কৃষক দরদি নেতা ছিলেন।
কৄষকরাই বাংলাদেশের প্রাণ। চাষীরা আমাদের অস্থিমজ্জা। তাঁদের কঠোর পরিশ্রমের ফলেই ফলে সোনালি ফসল, বাংলা হয় সোনার বাংলা। বাংলাদেশের সকল উন্নয়নে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য। তাঁরাই সবুজ রাখেন বাংলা মায়ের শ্যামল প্রান্তর। তাঁদের মুখে হাসি ফুটলে হাসে বাংলাদেশ। আমরা অবশ্যই চেষ্টা করবো তাঁদের ন্যায্য কথাগুলো শুনতে।
লেখক : সাবেক উপজেলা শিক্ষা অফিসার (টিইও)