মো.শাহাদাৎ হোসেন রাজু: "লালসালু" এই শব্দটার সাথে মোটামুটি আমরা সবাই পরিচিত। "লালসালু" বলতে এক ধরনের কাপড় বিষেশকেই বুঝি। যা গ্রাম-বাংলার শীত নিবারণের উপকরণ "লেপ" তৈরির লাল রংয়ে কাপড়কে বুঝায়। আবার বিভিন্ন মাজারে লাল রংয়ের কাপড়ের গিলাপকে বুঝায়। বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মাজার কেন্দ্রিক "লালসালু" নামে উপন্যাস লিখেছেন। যা ব্যাপক প্রংশিত হয়েছে।
লালসালু বলতে এক কথায় লাল রংয়ের পাতলা সূতি কাপড়কে বুঝায়। যা সালু কাপড় হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। আর এই লালসালু কাপড় লেপ তৈরির প্রধান উপকরণ বিশেষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শীত আসার আগে ধুমকার (লেপ-তোশক তৈরি করে যারা) দোকানগুলোতে লেপ তৈরির ধুম পড়ে যায়। তাইতো শীত আসার সাথে সাথে কদর বেড়ে যায় এই লালসালু কাপড়ের।
শীত ইতিমধ্যে ঘরের দরজার কাড়া নাড়ছে। চার দিকে বইছে শীতল বাতাস। তাইতো প্রকৃতি জানান দিচ্ছে শীত আসছে। শীতের আগমনের এই পূর্ব মুহূর্তে কদর বেড়েছে লালসালু কাপড়ের।
লোকসানের মুখে নরসিংদীতে লালসালু কাপড় তৈরির অনেক শিল্প-কারখানা ইতিমধ্যে মুখ থুবড়ে পড়েছে। বর্তমানে লালসালু কাপড় তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত সুতা, ক্যামিকেল ও রং এর দাম যে পরিমাণ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে কাপড়ের দাম সেভাবে বাড়েনি। তাইতো শিল্প মালিকরা প্রতিনিয়ত লোকসান গুনছে। ফলে এই শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে। সরকারি প্রণোদনাই এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে বলে অনেক শিল্প মালিক মনে করেন।
সারাদেশে লালসালু কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা থাকলে ইতিমধ্যে অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চাহিদার তুলনায় যোগান দিতে পারছে না নরসিংদীর লালসালুর তাঁতি পল্লী। যে কয়টি এখনো খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছে সেগুলোতে কাপড় তৈরীর ব্যাস্ততা বেড়েছে।
এ সময়ে নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকার সবুজ মাঠে শোভা পাচ্ছে লালসালু কাপড়। রোদে শুকাতে দেওয়া এসকল কাপড় দূর থেকে দেখলে মনে হয় কোন প্রেয়সী তার প্রিয়জনকে উষ্ণ সংবর্ধনা দিতে চিত্র শিল্পীকে দিয়ে সবুজ গালিচায় লালসালুর আলপনা এঁকে রেখেছেন।
বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা লাল রঙের কাপড় বহু যুগ ধরে নরসিংদীর মাধবদী বাবুরহাটসহ বিভিন্ন এলাকার মহাজনরা বিশেষ পদ্ধতিতে এ লাল সালু কাপড় তৈরি করে আসছে।
লেপ তৈরি, বিরিয়ানি বা হালিমের পাতিলের আবরণ, বিভিন্ন মাজারের গিলাপ ও পতাকা, বিপদ সংকেত ও জরুরি কিছু সাংকেতিক কাজে লাল নিশানা তৈরিতে এ লালসালু কাপড় প্রাচীন যুগ থেকে ব্যাবহৃত হয়ে আসছে।
অগ্রহায়ণ, পৌষ ও মাঘ এ তিন মাস এ কাপড়ের বেশ চাহিদা থাকে ফলে এসময়ে লালসালু তৈরির ধুম লাগে তাছাড়া বছরের অন্যান্য সময়েও স্বল্প পরিসরে এ কাপড় তৈরি করা হয়। সাদা মারখিন কাপড়ে প্রথমে রাসায়নিক কেমিক্যাল মিশিয়ে হলুদ রঙ করে তারপর হলুদ রঙের কাপড়ের উপর লাল রঙ করে কয়েক ধাপে কাপড়ের লাল রঙ ‘পাকা’ করা হয়। পরে দিগন্ত বিস্তীর্ণ খোলা মাঠে সারি সারি কাপড় বিছিয়ে দিয়ে শুকিয়ে সেখানেই ভাঁজ করে বিক্রির জন্য বান্ডিল আকারে লালসালু কাপড় প্রস্তুত করেন শ্রমিকেরা।
কাপড়ের রঙ করার কাজটি তিন থেকে চার মাসের জন্য হয়ে থাকে। এতে স্থানীয় শ্রমিকরা কাজ করলেও এর একটি বড় অংশ ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে আসে।
লালসালু কাপড় তৈরির কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ঈমন বলেন, প্রতিটি কাপড়ের রোলে এক হাজার গজের মতো কাপড় থাকে। প্রতিটি রোল (১ হাজার গজ) রং করে রোদে শুকিয়ে তা ভাঁজ করে মহাজনের নিকট পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত একজন শ্রমিক মজুরি হিসেবে পায় ৪ শত টাকা।
নুরুজ্জামান নামে অপর এক শ্রমিক বলেন, একজন শ্রমিক দিনে সর্বোচ্চ ২ হাজার গজ কাপড়ের কাজ করতে পারে। আমরা রং করা থেকে শুরু করে প্রখর রৌদের তাপ উপেক্ষা করে দিনে সর্বোচ্চ ৮ শত টাকা মজুরি পাই। বর্তমানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে এ টাকা দিয়ে সংসারের ভরণপোষণ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের।
লালসালু কাপড়ের তৈরির কারখানা মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, দীর্ঘ ৩০ বৎসর যাবৎ লালসালু কাপড় তৈরি করে আসছি। কিন্তু বর্তমান সময়ে সূতা, রং এবং কেমিক্যালের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার ফলে লোকসানের মুখে পড়ে অনেক কারখানাই বদ্ধ হয়ে গেছে। যে কারখানাগুলো এখনও চলছে সেগুলোও হুমকির মুখে পড়েছে।
নাজমুল আলম নামে অপর এক কারখানা মালিক বলেন সুতা, ক্যামিকেল ও রং এর দাম যে হারে বাড়ছে সে অনুপাতে কাপড়ের ন্যায্য দাম আমরা পাচ্ছি না। এর ফলে আমাদেরকে ক্রমাগত লোকসান গুনতে হচ্ছে। ইতোমধ্যে অনেকেই দেওলিয়া হয়ে কারখানা বদ্ধ করে দিয়েছে। এ শিল্প আজ ধ্বংসের দাঁড় প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারের এখনই নজর দেওয়া উচিত। নয়তো লালসালু শিল্প একদিন বিলীন হয়ে যাবে।কারখানা মালিকদের সরকারি প্রণোদনার মাধ্যমে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে আমি মনে করি।