স্টাফ রিপোর্ট: নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা তাজমুন্নাহারের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণ, দুর্নীতি, অনিয়ম ও শিক্ষকদের হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে।
তিনি গত ১৬ মে শিবপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার পদে যোগদান করেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি নিয়মিত অফিস করছেন না।
গত বৃহস্পতিবারে সকালে অফিসে হাজিরা দিয়ে ঢাকায় চলে যান। আবার রবিবার দিন ১১/১২ টায় অফিসে আসেন। নিয়মিত অফিস না করার কারণে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দিয়েছেন নরসিংদী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ শহিদুল ইসলাম। চিঠিতে বলা হয়েছে, বিনা অনুমতিতে গত ১১/৮/২০২৪ তারিখে অফিসে অনুপস্থিত থাকায় অফিসের প্রশাসনিক কার্যাদী সম্পন্ন করতে জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এমতাবস্থায় কেন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবর সুপারিশ করা হবে না কেন? তার সন্তোষজনক জবাব দিতে বলা হয়েছে।
উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, শিবপুর উপজেলায় ১৪২ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। গত ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে ১৪২ টি বিদ্যালয়ে শ্লিপ বাবদ ৪২ লাখ ৮০ হাজার টাকা, ৬৫ টি বিদ্যালয়ে ওয়াসব্লক বাবদ ১৩ লাখ ১০ হাজার টাকা , ৩০ টি বিদ্যালয়ে খুদ্র মেরামত বাবদ ৬০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি বিদ্যালয়ের কাজ সম্পন্নের ভাউচার পাশের ছাড়পত্র সহকারী শিক্ষা অফিসারগন প্রদানের পর উপজেলা শিক্ষা অফিসারের চূড়ান্ত ছাড়পত্রের মাধ্যমে উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিসার তাদের বিল ভাউচার যাচাই বাছাই করে শ্লিপের টাকা প্রতিটি বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে প্রদান করেন এবং ক্ষুদ্র মেরামত ও ওয়াস ব্লকের টাকা উপজেলা শিক্ষা অফিসারের ব্যাংক হিসাবে জমা করেন।
সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগণ শিক্ষা অফিসারের নিকট থেকে ক্ষুদ্র মেরামত ও ওয়াস ব্লকের চেক নিয়ে বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে জমা করে টাকা উত্তোলন করবেন। শ্লিপের টাকা সরাসরি বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসেবে টাকা জমা হওয়ায় শিক্ষা অফিসারের চেকের প্রয়োজন হয়না টাকা উত্তোলন করতে।
গত জুন মাসের পর অন্যের টাকা নিজের একাউন্টে দীর্ঘদিন রাখারও আইনত বিধান নেই। কিন্তু শিক্ষকগণ টাকা তুলতে পারছেন না। কারণ, শিক্ষা অফিসার সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ম্যানেজারকে বলে দিয়েছেন তার প্রত্যয়ন না পেয়ে যেন টাকা না দেন। আর ক্ষুদ্র মেরামত ও ওয়াস ব্লকের চেক ও দিচ্ছেন না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সহকারী শিক্ষা অফিসার, অফিসের কর্মচারী, একাধিক প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকগন জানান, শিবপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার তাজমুন্নাহার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লীগের রাজনীতি করতেন। সেই দাপট দেখিয়ে কর্মস্থলে বেশিরভাগ দিন অনুপস্থিত থাকেন। তার
নিয়োগকৃত ৩/৪ জন দালাল প্রধান শিক্ষক রয়েছেন। তাদের মাধ্যমে তিনি তার অবৈধ লেনদেন করে থাকেন।
তিনি কারও ফোন ধরেননা।বাধ্য হয়ে শিক্ষকগন বিদ্যালয় রেখে তার অফিসে এসে ভীড় করেন। তিনি শিক্ষক ও অফিস স্টাফদের সাথে আচরন খারাপ করেন।এরই মধ্যে তিনি তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন প্রকল্প যেমনঃ ক্ষুদ্র মেরামত, স্লিপ বরাদ্দ, ওয়াশব্লক বরাদ্দ ইত্যাদির বিল ভাউচার অনুমোদনের জন্য ঘুষ নিয়ে থাকেন। শিক্ষকদের নানা কাজে ঘুষ গ্রহণ করছেন। হাতিয়ে নিয়েছেন গত ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার গোল্ড কাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট এর ইউনিয়ন ভিত্তিক বরাদ্দের ৫০ হাজার টাকা। ১০টি ক্লাস্টারে ৫ হাজার টাকা করে ক্লাস্টার প্রধানকে দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি কাউকে এ টাকা না দিয়ে আত্মসাৎ করেন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকগন ব্যক্তিগত টাকা দিয়ে সরকারি ভ্যাট প্রদান এবং প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করলেও চেক গ্রহণ করতে ওনাকে ঘুষ দিতে হয়।
তিনি ব্যাংক ম্যানেজারকে বলে দিয়েছেন তার প্রত্যয়ন ছাড়া কোন শিক্ষককে যেন টাকা না দেওয়া হয়। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে ওনার চাহিদামত খুদ্র মেরামত থেকে ১০ হাজার টাকা, শ্লিপ ও ওয়াসব্লক থেকে ২ হাজার টাকা করে ঘুস, যারা দেন তাদেরকে প্রত্যয়ন দেন ও চেক দেন। আর যারা তার এই চাহিদামত ঘুষ দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন তাদের স্কুল ভিজিট করার কথা বলে হয়রানি করছেন। প্রতিদিনই বিদ্যালয় রেখে তাদের প্রকল্পের চেক ও প্রত্যয়ন গ্রহন করতে শিক্ষা অফিসের বারান্দায় ২০/৩০ জন প্রধান শিক্ষক ঘোরাফেরা করতে ও চিল্লাচিল্লি করতে দেখা যাচ্ছে।
প্রধান শিক্ষকদের গত অর্থ বছরের যাতায়াত বাবদ বিল করার জন্য কতিপয় দালাল শিক্ষকদের মাধ্যমে দুইশত টাকা করে উত্তোলন করে শিক্ষা অফিসার আত্মসাৎ করেছেন। শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের খবর সারা উপজেলায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে এবং শিক্ষকরা মানববন্ধন করার হুমকি দিলে তড়িঘড়ি করে প্রধান শিক্ষকদের তার অফিসে ডেকে আনেন।
এ সময় ধানুয়া ক্লাস্টারের ১২ জন প্রধান শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। তাদের কাছ থেকে ঘুস না নেওয়ার একটি প্রত্যয়ন নেন তিনি ।ফলে এনিয়ে শিক্ষকদের মাঝে আরো ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। গত আগষ্ট মাসে প্রধান শিক্ষকদের মাসিক সমম্বয় সভায় শিবপুর উপজেলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক মোঃ হানিফসহ কয়েকজন প্রধান শিক্ষক শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে প্রকল্পের টাকা নিয়ে হয়রানি, নিয়মিত অফিস না করা, ফোন না ধরা ও শিক্ষকদের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করেন।
এ সময় উপস্থিত ১৪২ জন প্রধান শিক্ষক তাদের প্রস্তাবকে সমর্থন করেন। এ সময় উপস্থিত শিক্ষা অফিসার তাজমুন্নাহার সভায় জানান প্রকল্পের টাকা নিয়ে শিক্ষকদের আর হয়রানি করা হবে না।
শিক্ষকদের সাথেও ভাল ব্যবহার করা হবে। অভিযোগ রয়েছে এর পরও তিনি তার অবস্থান পরিবর্তন করেননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রধান শিক্ষক জানান শিক্ষা অফিসার ঘুস ছাড়া প্রকল্পের টাকা দিচ্ছেন না।টাকা না দিলে শিক্ষকদের হয়রানি করছেন এবং শিক্ষকদের সাথে দুর্ব্যবহার করছেন।
উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে ধামরাই উপজেলায় দায়িত্ব পালনকালে এই শিক্ষা অফিসারের বিরুদ্ধে ৬/৯/২০২১ তারিখে বিভাগীয় মামলার শুনানীতে উপস্থিত থাকার নোটিশ করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রনালয়ের তদন্ত ও শৃংখলা শাখার তৎকালীন উপ-সচিব ফারহানা হক। সেই স্টেশনেও তিনি ছাত্র লীগের দাপট দেখিয়ে অনিয়ম আর লুটপাট করেছেন। যার জন্য তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা দেওয়া হয়েছিল। শিবপুর উপজেলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোঃ হানিফ, শিবপুর মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ কে এম মাসুদুর রহমান খান, যোশর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ মনির হোসেন, প্রধান শিক্ষক মোঃ বজলুর রহমান, আলমগীর হোসেন, মোঃ নজরুল ইসলাম, মো ফারুক মিয়া জানান শিক্ষা অফিসার টাকা প্রকল্পের টাকা নিয়ে শিক্ষকদের হয়রানি করছেন। বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা ফুটবল খেলার টাকা আমাদের কাউকে দেওয়া হয়নি।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সহকারী শিক্ষা অফিসার জানান বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল খেলার টাকা টিউও স্যার আমাদের কাউকে দেয়নি।
শিবপুর সোনালী ব্যাংক ম্যানেজার মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, শিবপুর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার তাজমুন্নাহার আমাকে বলেছেন, তার ছাড়পত্র ছাড়া কাউকে যেন টাকা না দেই। যারা তার ছাড়পত্রের প্রত্যয়ন নিয়ে আসেন শুধু তাদেরকেই টাকা দেওয়া হয়। এ পর্যন্ত ১৪২টি বিদ্যালয়ের মধ্যে ৪০/৫০ টি বিদ্যালয় টাকা নিয়েছে। শিবপুর উপজেলা শিক্ষা অফিসার তাজমুন্নাহার তার বিরুদ্ধে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন তিনি নিয়মিমত অফিস করছেন।ঘুস গ্রহণের অভিযোগ সত্য নয়।
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল খেলার টাকা ক্লাস্টার এটিওদের কাছে আছে।নরসিংদী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ শহিদুল ইসলাম জানান তার বিষয় নিয়ে শিবপুর থেকে ৪/৫ জন শিক্ষক আমার কাছে এসেছিল। আমি এ বিষয়ে অবগত আছি। বিষয়টি আমি দেখছি। শিবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শাহ মোঃ সজীব জানান এ ব্যাপারে আমাকে কেউ জানায়নি। জানালে বিষয়টি দেখা হবে।