মো.শাহাদাৎ হোসেন রাজু: প্রায় সাড়ে ৭ বছর পর নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর। সম্মেলনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে উৎসবভাব দেখা গেলেও কমিটি ঘোষণা নিয়ে রয়েছে চরম উৎকন্ঠা ও সংঘর্ষের আশঙ্কা।
সম্মেলনকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন দলীয় নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন তেমনি দলীয় গ্রুপিং ও কোন্দলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে ।
বেশ কয়েক মাস ধরে উত্তপ্ত নরসিংদীর রাজনীতি। বিবদমান দুটি গ্রুপের পাল্টাপাল্টি সভা সমাবেশ-মিছিলে জেলা আ’লীগের রাজনীতি এখন উত্তেজনায় ভরপুর। শুধু তাই নয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকেও একটি গ্রুপের সমর্থকরা অপর গ্রুপের নেতাদের নামে ছড়াচ্ছেন কুৎসা ।
নরসিংদী জেলা আ’লীগ মূলত দুভাগে বিভক্ত। একদিকে রয়েছেন সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নরসিংদী-১ (সদর) আসনের এমপি লে. কর্ণেল (অব.) নজরুল ইসলাম হিরু ও অপরদিকে রয়েছেন হিরুর এক সময়কার ঘনিষ্ট সহচর নরসিংদী পৌরসভার সাবেক মেয়র ও শহর আওয়ামীলীগের সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুল। সম্মেলনের দিনে ঘোষিত কমিটি যে গ্রুপের বিপরীতে যাবে সে পক্ষই সংঘর্ষে জড়াবে বলে স্থানীয় বেশির ভাগ সূত্র দাবি করছে।
এমপি নজরুল ইসলামকে সমর্থন দিচ্ছেন রাজি উদ্দিন আহমেদ রাজু এমপিসহ জেলা আ’লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। অপরদিকে সাবেক মেয়র সমর্থিত গ্রুপে রয়েছেন জেলার নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনের এমপি জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন (যদিও তিনি সম্মেলনে সভাপতি প্রার্থী), নরসিংদী-২ (পলাশ) আসনের সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খান পোটন ও তার সহোদর বর্তমান এমপি ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপ এবং জেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ জেলা আ’লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এ’দুটি পদ নিজেদের দখলে নিতে মরিয়া গ্রুপ দুটি। এরই মধ্যে গত বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) রায়পুরা উপজেলা আওয়ামীলীগের কর্মী সমাবেশে তেমনটারই ইঙ্গিত দেন সাবেক মন্ত্রী স্থানীয় এমপি প্রবীণ রাজনীতিবিদ রাজি উদ্দি আহমেদ রাজু। তিনি কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে কোনভাবে প্রভাবিত না হয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার আহবান জানান। কেন্দ্রীয় নেতাদেরকে হুঁশিয়ারিও দিয়ে বলেন, 'ভুল সিদ্ধান্ত দিলে, কেউ নরসিংদী থেকে ফিরে যেতে পারবেন না।’
পাশাপাশি সম্মেলনে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় স্থানীয় নেতাকর্মীদের রাজু বলেন ‘আগামী ১৭ তারিখ আমাদের জন্য একটি যুদ্ধক্ষেত্র। রায়পুরা থেকে আপনারা হাজার হাজার লোক সম্মেলনে যোগ দেবেন। আপনারা সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। এত সোজা নয়। আমরা রায়পুরার লোক, কাউকে ভয় পাই না।’ এ সময় সাতদিন আগে থেকেই সম্মেলনের মাঠ দখলে রাখতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন তিনি। কর্মী সমাবেশে সাবেক পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নরসিংদী-১ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম হিরু উপস্থিত ছিলেন।
কর্মী সমাবেশে এমপি রাজু সাবেক মেয়র কামরুলকে ইঙ্গিত করে কর্মীদেরকে বলেন, যারা দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে, যারা সন্ত্রাসী, আপনারা কি তাদের কে জেলা আওয়ামী লীগের পদে দেখতে চান?
তাই জেলা আ’লীগের সম্মেলনকে ঘিরে উত্তেজনার পারদ এখন চরমে। সংঘর্ষ ও যে কোন ধরনের নাশকতা এড়াতে সম্মেলনস্থলে কমিটি ঘোষণা না দিয়ে ঢাকা থেকে কমিটি ঘোষণা হলে সবার জন্য ভাল হবে বলে স্থানীয় অনেক নেতাকর্মীরা মনে করেন। যদিও সম্মেলনে কাউন্সিলরদের ভোটাভুটি ছাড়াই কমিটি ঘোষণা দিতে পারে কেন্দ্রীয় কমিটি।
আবার অনেক নেতাকর্মীরা বলছেন সিদ্ধান্ত যাই হোক না কেন ঘোষণা সম্মেলনস্থলেই দিতে হবে। নয়তো পদ বানিজ্য হতে পারে।
সম্মেলনে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত থাকবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলী সদস্য, কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক এমপি এবং প্রধান অতিথি থাকবেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি। সেই সাথে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখবে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি।
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করবেন নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিএম তালেব হোসেন ।
বিশেষ অতিথি থাকবেন সভাপতিমন্ডলী সদস্য লে. কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি, সভাপতিমন্ডলী সদস্য এড. কামরুল ইসলাম এমপি, সাবেক মন্ত্রী রাজি উদ্দিন আহম্মেদ রাজু এমপি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, শিল্পমন্ত্রী এড. নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন এমপি, আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক এড. নজিবুল্লাহ হিরু ও দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়াসহ কেন্দ্রীয় বেশ কয়েক নেতা উপস্থিত থাকবেন বলে জেলা আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে।
ঘোষিত কমিটি যে কোনভাবেই হোক উভয় গ্রুপই তাদের পক্ষে নেওয়ার চেষ্টা করবে । আর পক্ষে না গেলে হতে পারে রক্ষক্ষয়ী সংঘর্ষ ।
একাধিক সূত্রমতে, সম্মেলনে দুই-তিনদিন আগ থেকেই বিভিন্ন উপজেলার লোকজন জেলা শহরে এসে অবস্থান করবে। লক্ষ্য একটাই কমিটি পক্ষে না গেলে হট্টগোল-সংঘর্ষ সৃষ্টি করা। বিগত পৌরসভা নির্বাচন ও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও এমনই চিত্র দেখা গেছে। তাই নরসিংদী শহরবাসী এই সম্মেলনকে ঘিরে অনেকটাই আতংকিত রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতৃবৃন্দ জানান- এ সম্মেলনকে ঘিরে জেলার অস্ত্রধারি সন্ত্রাসীরা সক্রিয় । তারা সম্মেলনের দিনে অপ্রীতিকর ঘটনার সৃষ্টি করতে পারে। তাই এখানে কমিটি ঘোষণা না করে কেন্দ্র থেকেই ঘোষণা করলে আ’লীগের জন্য মঙ্গলকর হবে, সংঘর্ষও এড়ানো সম্ভব হবে।
সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে আলোচনায় রয়েছেন প্রায় ডজনখানেক নেতা।
সভাপতি পদে একাধিক ব্যক্তির নাম শুনা যাচ্ছে। তারা হলেন- নরসিংদী-১ (সদর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম হিরু (বীরপ্রতীক), নরসিংদী-২ (পলাশ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ী কামরুল আশরাফ খান পোটন, নরসিংদী-৩ (শিবপুর) আসনের সংসদ সদস্য জহিরুল হক ভূঁইয়া মোহন, জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিএম তালেব হোসেন।
সাধারণ সম্পাদক পদে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন অর রশিদ, জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একরামুল ইসলাম ভূঁইয়া, বাংলাদেশ কৃষক লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আমিরুল ইসলাম ভূঁইয়া, কেন্দ্রীয় তাঁতীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোন্তাজ উদ্দীন ভূঁইয়া, সাবেক পৌর মেয়র ও বর্তমান শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুজ্জামান কামরুল, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আফতাব উদ্দিন ভূঁইয়া, নরসিংদী শহর যুবলীগের সাবেক সভাপতি আশরাফ হোসেন সরকার, জেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী, সাবেক যুবলীগ নেতা আসাদুজ্জামান খোকা।
নরসিংদী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিএম তালেব হোসেন বলেন, 'কোন সংঘর্ষের আশঙ্কা করছি না। আওয়ামীলীগ একটি বড় দল এবং বর্তমানে দল ক্ষমতায় রয়েছে। কাজেই দলের মধ্যে গ্রুপিং-লবিং ও দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। আমি আশা করি সফলভাবেই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনস্থলে সিসি ক্যামেরা সংযোজন করা হয়েছে।'