নিজস্বপ্রতিনিধি: যাদের রক্তের বিনিময়ে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন হয়েছে সোনার বাংলা। সেই সকল বীর সন্তানদের সম্মননা দিতে সরকার তাদের নামের পূর্বে বীর লেখা বাধ্যতামূলক করার পাশাপাশি তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের পরিপত্র জারি করেন। এরপরও দেখা গেছে প্রশাসনের গাফিলতিতে বীর সন্তানদের অনেকটা অবহেলায় দায়িত্বহীনভাবে সম্মাননা শেষ করেন। তেমনই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: লাল মিয়া।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: লাল মিয়া ১৭ জুলাই (রোববার) বিকেল সাড়ে তিনটার সময় উপজেলার জিনারদী ইউনিয়নের মাঝেরচর আশ্রায়ন প্রকল্পে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নালিল্লাহি রাজিউন)। সাথে সাথেই তার পরিবারের পক্ষ থেকে স্থানীয় একজন সাংবাদিক, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানানো হয়।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মো: কামরুল ইসলাম গাজী ১ঘন্টার মধ্যে উপস্থিত হয়ে প্রথমে বিকেল ৫টায়, পরে সাড়ে ৫টায় এবং সর্বশেষে ৬টায় পলাশ উপজেলা পরিষদ জামে মসজিদ প্রাঙ্গণে জানাযা নামাজ পড়ার জন্য মাইকে ঘোষণা করেন।
এদিকে মরহুম লাল মিয়ার গোসল শেষে লাশ একটি পিকআপ ভ্যানে করে মাঝেরচর আশ্রায়ন প্রকল্প থেকে উপজেলা মসজিদে নিয়ে যাওয়া হয়। জানাযা নামাজের জন্য মুসল্লিগণ লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক মন্টুসহ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও উপস্থিত। কিন্তু উপস্থিত নেই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। এসময় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কামরুল ইসরাম গাজীর কাছে উপস্থিত মুসল্লিগণ জানাযার নামাজ পড়ার বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানোর জন্য পুলিশকে জানানো হয়নি। তাই পুলিশ আসতে সময় নিচ্ছে। এতে উপস্থিত মুসল্লিগণ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
ঘটনার পেছনের কারণ জানতে গিয়ে জানা গেছে, পলাশ উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা ফারহানা আফসানা চৌধুরী কর্মস্থলে উপস্থিত থাকলে তিনি নিজেই মুক্তিযোদ্ধার রাষ্ট্রীয় সম্মাননার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। ওই দিন তিনি নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান এর ধর্মিণী রিফাত আখতার পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসায় বেড়াতে যান। আর সেই কারণে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। যার কারণে তিনি অফিস থেকে মাত্র দশ গজের মধ্যে হলেও একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে যেতে পারেননি।
এরজন্য নরসিংদী জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম হাসানুর রহমানকে ডেকে আনতে হয়েছে। এদিকে জানাযা নামাজের সময় ৬টা গড়িয়ে গেলে পুনরায় সাড়ে ৬ টায় পড়ার ঘোষণা দেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান। অপরদিকে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। আর সূর্য ডুবে গেলে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেয়ার প্রকৃয়াটিও করা সম্ভব নয়।
অবশেষে পুলিশ আসলো সন্ধ্যা প্রায় ৬টা ৪০ মিনিটে এবং ৬টা ৪৫ মিনিটে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানো শেষে জানাযা নামাজ সম্পন্ন হয়। এর সাথে সাথেই মাইকে মাগরিবের নামাজের জন্য আজান দেয়া হয়।
পরবর্তীতে রাত ৯ টায় নিজ জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে দ্বিতীয় জানাযা শেষে দাফন সম্পন্ন হয়।
পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহানা আফসানা চৌধুরী এবিষয়ে জানান, 'রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে নরসিংদী থেকে ম্যাজিস্ট্রেট আনা হয়েছে। কোন সমস্যা হয়নি। যথা সময়েই জানাযা হয়েছে। বরং তাদের পরিবার চাচ্ছিল কিশোরগঞ্জ নিয়ে দাফন করতে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করে থাকি।'
এবিষয়ে পলাশ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ ইলিয়াছ জানান, 'কোন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলে আমাদেরকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান বা মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে জানালে আমরা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানানোর বিষয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করে থাকি। কিন্তু এই ঘটনায় সন্ধ্যা ৬ টায় আমাদের জানানোর পর নরসিংদী থেকে পুলিশ এসে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।'
পলাশ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মোজাম্মেল হক মন্টু এ বিষয়ে জানান, 'বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা যথা সময়ে যেতেও আমাকে জানাননি। আমি ব্যক্তিগত কাজে নরসিংদী গিয়েছিলাম সেখান থেকে আসার পথে শোনে চলে আসছি। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় মযাদায় দাফনের বিষয়ে এমন গাফিলতি আমাদের কাম্য নয়।'
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: লাল মিয়া, যুদ্ধ করেছেন সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর তীরে। তার জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার বড় ছয়সুতি গ্রামে। তার পিতার নাম মফিজ উদ্দিন।
তিনি যুদ্ধ শেষে দেশ স্বাধীনের পর কিছুদিন সুনামগঞ্জে চাচার বাড়ি থেকে নিজ এলাকা কুলিয়ার চরে এসে দেখেন তাঁর জমিতে স্কুল ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। তিনি সেই জায়গা স্কুলের জন্য দিয়ে দেন।
এরমধ্যে তিনি প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে এক হাত এক পা অচল হয়ে যায়। জীবিকার তাগিদে নরসিংদীর পলাশে চলে আসেন। এখানে পলাশ ও ঘোড়াশাল সারকার খানা গেইট এলাকায় দীর্ঘ ৪০ বছর ভিক্ষা করে জীবন চালিয়েছেন। রাত যাপন করেছেন উপজেলা পরিষদ, বিভিন্ন স্কুলের বারান্দা ও ভাংগা অডিটরিয়ামে।
যেই থেকে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ভাতা প্রাপ্ত হলেন সেই থেকে তিনি ভিক্ষা ছেড়ে দেন। এরমধ্যেই তিনি শ্বাসকষ্ট আর চর্মরোগ ও বার্ধক্যজনিত কারণে বিছানায় শয্যাাসায়ী হয়ে পড়েন। এছাড়া ভাতা পাওয়ার পর থেকে তিনি উপজেলা এলাকায় একটি মাটির ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস করতে থাকেন।
অবশেষে তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে প্রাপ্ত আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘর পান এবং সেই ঘরেই তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি ৪ ছেলে ও স্ত্রী রেখে যান।