• নরসিংদী
  • মঙ্গলবার, ৭ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ; ২২ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

Advertise your products here

Advertise your products here

নরসিংদী  মঙ্গলবার, ৭ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ;   ২২ অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
website logo

পাঁচদোনায় শিল্প কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যালে পুড়ছে ফসলি জমি গাছপালা


জাগো নরসিংদী 24 ; প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ২২ মার্চ, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ১১:৩৩ পিএম
পাঁচদোনায় শিল্প কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যালে পুড়ছে ফসলি জমি গাছপালা
ছবি প্রতিনিধি

মো.শাহাদাৎ হোসেন রাজু: নরসিংদীর পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা  বিভিন্ন কল কারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত বিষাক্ত পানিতে নদের মাছ, প্রাণিসহ পাশ্ববর্তী এলাকার গাছপালা ও ফসলী জমির ফসল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের  নি:শ্বাসেই যেন বিষ। প্রতিনিয়ত এই বিষ ছড়ছে আশপাশের এলাকায়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ, পশু-পাখি ও ফসলি জমি। এই বিষাক্ত পানির ছোঁয়া যেখানেই পড়ে সেখানের সবকিছু পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।

সদর উপজেলার পাঁচদোনা এলাকায় গড়ে ওঠা এসকল কল-কালখানার পানি নিষ্কাশনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় নদীর তীরবর্তী ফসলী জমি বিষাক্ত পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। এসকল কল-কারখানার বিষাক্ত পানিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমাধবদী ও মূলপাড়া এলাকার কৃষকরা। 

পাঁচদোনা এলাকার কল-কারখানার দূষিত পানিতে নষ্ট হচ্ছে পাশ্ববর্তী কৃষকদের ফসলি জমি। এতে প্রায় ৩ হাজার বিঘা জমির ধান চাষ ব্যাহত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কলকারখানা গুলোর কেমিক্যাল মিশ্রিত ও দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত ময়লা পানি বন্ধে এলাকাবাসী  মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা সহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পায়নি। 

এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, হাড়িদোয়া নদীর পাশেই রয়েছে ছোট্ট একটি খাল। আর সেই খালে পাকিজা গ্রুপের মম টেক্সটাইল, চায়না বাংলা সিরামিক, আমানত শাহ স্পিনিং মিল ও ক্রোমা টেক্সটাইল মিলের বিষাক্ত বর্জ্য ও দূষিত পানি পুরাতন ব্রহ্মপুত্রে পতিত হয়ে নদের পানির সাথে মিশে ক্রমাগত পরিবেশ দূষণ করে যাচ্ছে। এই দূষিত পানির কারণে অনেক আগেই নদী থেকে দেশিয় প্রজাতির মাছ বিলীন হয়ে গেছে। এখানে  মাছ তো দূরের কথা ব্যাঙ থেকে শুরু করে সকল প্রকার জলজ প্রাণীর জন্য এ পানি মৃত্যুকুপে পরিণত হয়েছে।

এই পানি নদের পাশ্ববর্তী জমিতে ছড়িয়ে গিয়ে ফসল নষ্ট করার পাশাপাশি জমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট করে দিচ্ছে। নদীপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো একে একে মরে যাচ্ছে। এতে মারাত্মক ভাবে পরিবেশ  বিপর্যয় ঘটছে। কারখানার বিষাক্ত পানির কারণে ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে নরসিংদীতে গড়ে ওঠা  কৃষিনির্ভর অর্থনীতি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। পাঁচদোনা ইউনিয়নের চরমাধবদী, মুলপাড়া, বাগবাড়ি, ভাটপাড়া, কুড়াইতলী, নেহাবসহ এসব মৌজার প্রায় ৩ হাজার বিঘা ধানি রয়েছে বলে জানান এলাকার কৃষক।

দূষিত এই পানির ফলে জমি তার উর্বরতা শক্তি হারিয়ে ক্রমেই এসব এলাকার আবাদি জমির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।কৃষকরা জানান, শিল্প কারখানাগুলোর দূষিত পানি ফসলি জমিতে ঢুকে ফসল নষ্ট হলেও কৃষকরা এর কোন প্রতিকার বা ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছুই পায় না । কৃষকদের এই ক্ষতি হওয়াটাকে ঢাল বানিয়ে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর মহল কারখানাগুলো থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদাবাজী করে যাচ্ছে ।

এলাকাবাসী জানায়, কয়েক বছর আগেও ব্রহ্মপুত্র ও সুয়ারেজ খালটির পানি ব্যবহার করে এলাকার কৃষকরা সব ধরনের চাষাবাদ করতেন। বর্তমানে পাকিজা গ্রুপের মম টু, ক্রোমা টেক্সটাইল, সানফ্লাওয়ার ডাইং, সিবিসি সিরামিক ও আমানতশাহ ডাইংসহ বিভিন্ন কল-কারখানা নির্মাণের পর এর পানি দূষণ অতিমাত্রায় বেড়ে যায়। বর্তমানে এখানকার পানি ব্যবহারতো দূরের কথা পানিতে হাত লাগানোই মুশকিল । এ পানি এতটাই বিষাক্ত যে শরীরের যে কোন অংশে এর ছিটে ফোটা পড়লে সেখানে ফোস্কা পড়ে যায়। পাকিজা সহ বিভিন্ন কল- কারখানার দূষিত পানি উপচে পড়ে ঢুকছে কৃষকের ফসলি জমিতে । এতে ধানের জমিগুলোতে আগের মতো ফসল তো হয়ই না, বরং ওই খাল দিয়ে এসব কারখানার দূষিত পানি প্রবাহিত হয়ে জমিতে ঢুকে পড়ায় ধান ক্ষেতে লাগানো চারাগুলো পচে যাচ্ছে।

কৃষক হবি মিয়া জানায়, তার ৮ কানি জমিতে তিনি ধান আবাদ করেছেন। জমিতে তিন দফায় বিভিন্ন শিল্প কারখানার কেমিক্যাল মিশ্রিত পানি জমে ফসল নষ্ট হয়ে গেছে । ৮ কানি জমি থেকে ৮ মন ধান পাবেন কিনা সেই ব্যাপারে তিনি সন্দিহান রয়েছেন। 

চরমাধবদী এলাকার কৃষক সামাদ  বলেন, পাকিজা টেক্সটাইল, আমানত শাহ ও ক্রোমা টেক্সটাইল মিলের দূষিত পানি এতোটাই ক্ষতিকর যে জমিতে ঢুকে পড়া ওই পানির ফলে সকালে লাগানো ধানের চারাগুলো বিকেলেই পচে যায়।  বার বার চারা লাগাতে গিয়ে চারা ও শ্রমিকের খরচ বাবত তার প্রায় তিনগুণ অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল।  এতটাকা খরচ করেও কত মন ধান পাবেন তা তিনি জানেন না। এ অবস্থায় তিনি তার পরিবার পরিজনের মুখের আহার কিভাবে যোগাবেন তা নিয়ে  মহা দুশ্চিন্তায় আছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য তিনি যথাযথ কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন।

একই এলাকার কৃষক ওমর ফারুক বলেন, কিছুদিন পর পরই এসকল কারখানার পানি ড্রেনের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তাদের জমিতে ঢুকে তাদের ফসল নষ্ট করে দেয়। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীসহ স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষন করেন তিনি।

পাঁচদোনা এলাকার বাসিন্দা ও ঘোড়াশাল পৌর যুবলীগের সভাপতি মনির মোল্লা বলেন, বিভিন্ন শিল্প কারখানার বর্জ্য ও দুষিত পানিতে প্রায় সময় আমাদের এই এলাকার প্রায় ৪/৫টি গ্রামের ফসলি জমির নষ্ট হয়ে যায়। আমি এলাকার ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের স্বার্থে এবং এর থেকে প্রতিকার পেতে জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ এর সাথে সম্পৃক্ত দপ্তরগুলোকে অবগত করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

পাঁচদোনা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, বর্তমানে তার ইউনিয়নে প্রায় ১৫ থেকে ২০টি বড় বড় শিল্প কারখানা রয়েছে। এই কারখানাগুলোর পানি অপসারিত হওয়ার ড্রেনটি যে সময় নির্মাণ করা হয়েছিল সেসময় এলাকায় মাত্র একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল। তাই তখন তেমন কোন সমস্যা হয়নি। বর্তমানে প্রতিনিয়ত কারখানা গুলো থেকে যে পরিমাণ পানি বের হয় তা এই সরু ড্রেনের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রে ফেলা দুরুহ ব্যাপার।

যার ফলশ্রুতিতে ফসলী জমি নষ্ট হওয়া সহ অনাকাঙ্ক্ষিত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আর এসকল বিষয় মাথায় রেখে ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে জমি ক্রয় করে ৬ ফুট চওড়া একটি ড্রেন নির্মাণ করা হচ্ছে। যা নগর পাঁচদোনা থেকে শুরু হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে পড়বে। এটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে এ অঞ্চলের মানুষের  আর এধরনের সমস্যায় পড়তে হবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

নরসিংদী পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাফিজুর রহমান বলেন, শুধু পাঁচদোনা নয় পুরো জেলার সকল শিল্প কারখানাগুলো জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর সার্বক্ষণিক মনিটরিং সহ নিয়মিত ভিজিট করে যাচ্ছে। কোন শিল্প কারখানার বিরুদ্ধে পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন অভিযোগের ভিত্তিতে কারখানা পরিদর্শন করে এর প্রমান পাওয়া গেলে ওই কারখানা কর্তৃপক্ষকে অর্থ দন্ডে দন্ডিত করা হয়। তবে কোন অভিযুক্ত শিল্প কারখানার বিরুদ্ধে জেলা অফিস কোন পদক্ষেপ গ্রহন করতে পারে না। কারখানাগুলোর ইটিপি প্লাট সংক্রান্ত পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের একটি বোর্ড রয়েছে। জেলা অফিসের তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ওই বোর্ড কারখানা কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন দন্ড প্রদান করে থাকে।

নরসিংদী কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহাব্যবস্থাপক আতিকুর রহমান মুঠোফোনে জানান, তারা মূলত কল-কারখানাগুলোর শ্রমিকদেরকে দেখাশোনা করে থাকেন। অন্যান্য বিষয়গুলো পরিবেশ অধিদপ্তরের আওতায় আসেনা।

এব্যাপারে তার ভিডিও বক্তব্যের জন্য সময় চাইলে  উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া ক্যামেরার সামনে কোন বক্তব্য দিতে পারবেনা বলে জানান তিনি। এসময় উক্ত দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক তৌওহিদুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

নরসিংদীর খবর বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ