স্টাফ রিপোর্টার: আজ ৬ ডিসেম্বর ঘোড়াশাল ট্রাজেডির বেদনাবিধূর সেই দিন। ১৯৭১ সালের এইদিনে মহান মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ৯ দিন বাকি। মুক্তিকামী বাঙালি মুক্তিসেনাদের আক্রমণে যখন দেশজুড়ে কোণঠাসা হয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী। ঠিক তখনই তৎকালীন কালীগঞ্জ থানার ঘোড়াশালের আটিয়াগাঁও গ্রামের আবুল কাসেমের বাড়িতে মরণ কাঁমড় দেয় পাক হানাদার বাহিনী। চালায় সর্বশেষ নির্মম হত্যাকাণ্ড।
আজও এই এলাকার কিছু মানুষ বিজয়ের মাস এলে গভীর শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। তবে ঘোড়াশালের নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই পাক হানাদার বাহিনীর এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের ইতিহাস অজানা।
সেদিনের সেই নির্মম ঘটনার বর্ণনা দেন ঘোড়াশালের বীর মুক্তিযোদ্ধা আনিসুল হক ও রফিক ভূঁইয়া। তারা জানায়, ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে রাজাকারদের সহযোগিতায় আবুল কাসেমের বাড়ি দুই দিক থেকে ঘেরাও করে আগুন ধরিয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী। এদিন আবুল কাসেমের বাড়িসহ আশে পাশের আরও ১০/১২টি বাড়িতে আগুন দেয় পাক বাহিনী।
এসময় আবুল কাসেম তার পরিবার সদস্যদের নিয়ে ঘরের ভেতর করা একটি মাটির গর্তে লুকিয়ে থাকেন। আগুন জ্বলেতে থাকা বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে কোন চিৎকার চেচামেচি শুনতে না পেয়ে ঘরের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকে হানাদার বাহিনী। পরে মাটির গর্তে লুকিয়ে থাকা শিশুসহ ৩২ নারী-পুরুষ উঠানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে দেয়। আচমকা গর্জে উঠলো রক্ত পিপাসু পাক নরপশুদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলো। মেশিনগানের গুলিবিদ্ধ হয়ে বাড়ির উঠানেই ঢলে পড়ে শিশুসহ ১৮ নারী-পুরুষের নিথর দেহ। এদিকে নিহতদের সাথে সাথে গুলির শব্দে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে যায় আবুল কাশেম। এ পাক সেনারা ধারণা করে সেও বোধ হয় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছে আর তাই ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এসময় গুরুতর আহত হন ৬ জন।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ৬ ডিসেম্বরের এই দিনটিকে স্থানীয়রা ঘোড়াশাল ট্র্যাজেডি দিবস হিসেবে আখ্যায়িত করে। সেদিন শহীদ হন মোকছেদ আলী, মালাবঙ্, শাহাজাহান, রহম আলী, আ. হেকিম, হযরত আলী, আম্বিয়া খাতুন, মজিদা, শিশু পুত্রসহ আয়শা, শাহাজ উদ্দিন শাহা, নেহাজউদ্দিন চুইল্লা ও নেজু প্রমুখ।
ভাগ্যক্রমে সেদিন প্রাণে বেঁচে যাওয়া আবুল কাসেম স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর ২০১৬ সাথে মৃত্যুবরণ করেন। ইতোমধ্যে স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিবাহিত হলেও ঘোড়াশালের সেই শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় সরকারীভাবে নেওয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ । যা সত্যিই উদ্বেগজনক।
স্থানীয়রা জানান, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এদেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এই তিনটি রাজনৈতিক দল ঘুরে ফিরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলেও মহান মুক্তিযুদ্ধে সেই সকল শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় কোন উদ্যোগ গ্রহন করেনি। এমনকি সরকারিভাবে নিহতের স্মরণও করা হয়নি, নেওয়া হয়নি কোন কর্মসূচি। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্থানীয়রা। রাজনৈতিক দল ও সরকারে এমন নিস্ক্রিয়তায় ঘোড়াশাল ট্রাজেডির এই দিনটির ইতিহাস অজানা রয়ে গেছে নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে।
তাই বিজয়ের এই ক্ষণে দাঁড়িয়ে ঘোড়াশালবাসীর প্রাণের দাবী ৬ ডিসেম্বর ঘোড়াশাল ট্রাজেডির শহিদদের স্মৃতি ধরে রাখতে একটি স্মৃতিস্মারক নির্মানের জন্য উদ্যোগ গ্রহন করার।