স্টাফ রিপোর্টার:নরসিংদীর চরাঞ্চলে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে রেজন মিয়া (৫৫) নামে একজনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গত বৃহস্পতিবার (২৩ মে) ভোরে নরসিংদী সদর উপজেলার চরাঞ্চল আলোকবালী ইউনিয়নের খোদাদিলা গ্রামে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ঢাকায় চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় শনিবার (২৫ মে) বিকেলে রেজন মিয়া মারা যায়। এ ঘটনায় আহত হয়েছে প্রায় ২০ জন। আহতদের মধ্যে ৬ জনকে নরসিংদী সদর হাসপাতাল এবং ৪ জনকে জেলা হাসপাতালে আনা হয়। তাদের মধ্যে টেটা বিদ্ধ অবস্থা কুতুব উদ্দিন নামে এক ব্যক্তিকে সদর হাসপাতালে আনা হলে তাকে এবং জেলা হাসপাতাল থেকে তৈয়ব ও আব্দুল্লাহ নামে দুইজনসহ মোট তিনজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকায় পাঠানো হয়। বর্তমানে তারা ঢাকায় চিকিৎসাধীন আছেন। তবে নিহত রেজন মিয়াকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সরাসরি ঢাকা নিয়ে যাওয়া হয় সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
নিহত রেজন মিয়া খোদাদিলা গ্রামের মৃত আবু তাহেরের ছেলে। তিনি খোদাদিলা গ্রামের আইজ্জার গোষ্ঠির লোক বলে জানা যায়।
বৃহস্পতিবার (২৩ মে) ভোররাতে খোদাদিলা গ্রামে এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের নেপথ্যে কি ছিলো সে প্রশ্নে উত্তর নরসিংদী ক্রাইম নিউজের এই প্রতিবেদক খুঁজতে গিয়ে জানতে পারে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারে ওই গ্রামের আইজ্জার গোষ্ঠি ও ইছাগুরি গোষ্ঠির লোকদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলে আসছিল। মূলত এলাকায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে ও সরকারী প্রকল্পের বালু ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকে ঘিরে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
আর এই সংঘর্ষের ইন্ধনদাতা হিসেবে যাদের নাম উঠে এসেছে। তারা হলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আইজ্জার গোষ্ঠির বজলুর রহমান ফাহিম (ফাহিম সিদ্দিকী) ও ইউনিয়ন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক জয়নাল আবেদিন এবং যুবলীগ কর্মী ইছাগুরি গোষ্ঠির জাকির হোসেন। মূলত তাদের ইশারায় খোদাদিলা গ্রামের বিভিন্ন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটচ্ছে বলে এলাকা বাসী জানায়।
জানা যায়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে মেঘনা নদী ও তার শাখা নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিতে নদী থেকে বালু উত্তোলন গত দুই মাস আগে শুরু হয়। প্রকল্প অনুযায়ী এসব বালু নদীর পাশে রাখার কথা হলেও নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে আলোকবালী ইউনিয়নের সাতপড়া ও খোদাদিলা, বাখরনগর সহ বিভিন্ন গ্রামের ফসলী জমি, পুকুর, ডুবা সহ বিভিন্ন স্থান ভরাট করা হচ্ছে। আর এসব জায়গা বালু ভরাটের প্রতি শতাংশে ফাহিম সিদ্দিকীর ও জয়নাল আবেদিনের লোকদেরকে ১০-১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এ বালু ব্যবসায়ে আইজ্জার গোষ্ঠির ১০ জন লোক ভাগ পেলেও ইছাগুরি গোষ্ঠির কাউকে এর ভাগ দেয়া হয়না। ফলে ইছাগুরি গোষ্ঠির জাকির ও তার লোকরা ভাগ না পাওয়ায় এর প্রতিবাদ করে এবং ভাগ দাবী করে।
গত ২৮ এপ্রিল ইছাগুরি গোষ্ঠির আমানুল্লাহ নামে এক ব্যক্তি অবৈধ এই বালু ব্যবসার ভাগ চাইতে গেলে তাকে চর থাপ্পড় মেরে বের করে দেয়া হয়। ফাহিম ও জয়নাল এতেও তারা ক্ষান্ত হয়নি। আমানুল্লাহ যদি দল পাকায় এই ভয়ে পরের দিন ২৯ এপ্রিল ফাহিম ও জয়নালের নির্দেশে আইজ্জার গোষ্ঠির লোকজন ইছাগুরির গোষ্ঠির লোকজনদের উপর হামলা চালিয়ে তাদেরকে গ্রাম ছাড়া করেন।
সেই থেকেই খোদাদিলাসহ আশপাশের গ্রামের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে ছিল কখন জানি দু'পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে।
এদিকে ইছাগুরি গোষ্ঠির লোকজন গ্রামের বাইরে থেকে সংঘবদ্ধ ও নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। সেই সাথে এলাকায় ঢুকার সুযোগ খুজতে থাকে। বৃহস্পতিবার ভোর চারটার দিকে পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকজন নিয়ে তারা এলাকায় প্রবেশ করে। তাদের এলাকায় প্রবেশের বিষয়টি ফাহিম ও জয়নালের নেতৃত্বাধীন আইজ্জার গোষ্ঠির বুঝতে পেরে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলে দুই গোষ্ঠির লোকদের মধ্যে এই সংঘর্ষ বাঁধে। সংঘর্ষে টেটা ও গুলিবিদ্ধ হয়ে উভয় পক্ষের প্রায় ২০ জন আহত হয়। তাদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চারজনকে ঢাকা পাঠানো হয়। শনিবার বিকেলে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহত রেজন মিয়া মারা যায়।
এদিকে রেজন মিয়ার মৃত্যুর খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ইছাগুরি গোষ্ঠির লোকেরা গ্রেফতার এড়াতে গ্রাম ছেড়ে পালায়।
খোদাদিলা ও আশপাশের গ্রামবাসীদের জিজ্ঞাসা এভাবে আর কতদিন এই দুই গোষ্ঠির লোকদের কাছে জিম্মি থাকতে হবে। আর কত প্রাণ গেলে ফাহিম, জয়নাল ও জাকির শান্ত হবে। কতজন গ্রামবাসীর প্রাণ তাদের প্রয়োজন। এ দুই গোষ্ঠির জিম্মি দশা থেকে মুক্তি চায় খোদাদিলা গ্রামের নিরীহ মানুষ। এব্যাপারে নিরীহ গ্রামবাসী প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
ইছাগুরি গোষ্ঠির জাকির হোসেনের সাথে কথা বলতে তার মোবাইলে ফোন করলে রেজন হত্যা মামলার আসামী হয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। তাই সম্ভবত তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এব্যাপারে আইজ্জার গোষ্ঠির সেকেন্ড ইন কমান্ড বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদীনের সাথে যোগাযোগ করতে তার মোবাইলে বেশ কয়েকবার ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
পরে আইজ্জার গোষ্ঠির প্রধান আলোকবালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফাহিম সিদ্দিকীর সাথে যোগাযোগ করতে তাকে তার মোবাইলে ফোন করলে প্রতিবেদকের ফোনটি রিসিভ করলে ‘খোদাদিলার দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মূলে আপনি এই কথাটা কতটুকু সত্য‘ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন , এটা সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমি নরসিংদীতে থাকি, ঈদ বা পারিবারিক কোন অনুষ্ঠান ছাড়া গ্রামে আসা হয় না। ‘আপনি তো সরকারি চাকরি করেন এবং আপনার কর্মস্থল আলোকবালী ইউনিয়নে। চাকুরির স্বার্থে ও রুটিন ওয়াক করতেও কি, যান না? আর আপনি সরকারি চাকুরিজীবি। চাকুরিতে থেকে আওয়ামী লীগের কমিটিতে কিভাবে আছেন? প্রতিবেদকের এমন পাল্টা প্রশ্নের উত্তরে বলেন আলোকবালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে আমি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি। অন্য প্রশ্নের কোন সদুত্তর ফাহিম সিদ্দিকী দিতে পারেনি।
ফাহিম সিদ্দিকীর বক্তব্যে চাকুরি ব্যাঘাত হবে ভেবে আলোকবালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করছেন বলে প্রতিবেদককে জানালেও প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাকে প্রথম সারিতে দেখা যায়।তাছাড়া বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নজরুল ইসলাম হিরু জয়লাভ করলে তাকে বিজয় মিছিল বের করতে দেখা যায় যার ভিডিও নরসিংদী ক্রাইম নিউজ কার্যালয়ে সংরক্ষিত আছে।