নিজস্ব প্রতিনিধি: নরসিংদীতে একই নামে একই গ্রামে এক আধ্যাত্মিক ব্যক্তির নামে পৃথকভাবে দুই মাজার গড়ে তুলে ৩৫ বছর ধরে চলছে ওরস শরীফ।
এক মাজারের পাশে দাফন করা হয়েছে আধ্যাত্মিক ব্যক্তির লাশ। আর অন্যটিতে দেয়া হয়েছে কলাগাছ চাপা।
যেখানে কলা গাছ চাপা দেয়া হয়েছে সেখানেও গড়ে তোলা হয়েছে মাজার! আর এই ঘটনাটি ঘটছে নরসিংদীর বেলাব উপজেলায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেলাব উপজেলায় ফকির চাঁন মিয়া শাহ ওরফে কলসী ওয়ালা নামে এক ফকির ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর থেকেই এ ঘটনা ঘটছে।
এলাকাবাসী জানান, ৩৬ বছর আগে মারা যাওয়া আধ্যাত্মিক পুরুষ চাঁন মিয়া শাহের এই দুই মাজারেই চলে একই তারিখে বাৎসরিক ওরশ মাহফিল।
চলে ভক্তদের মানত প্রদান, মাজার জিয়ারতও। চলতি মাসের ১০ ও ১১ তারিখে এই দুই মাজারেই অনুষ্ঠিত হবে বাৎসরিক ওরশ।
দুই মাজারের মধ্যে কলাগাছ দাফন করা মাজারটিকে এলাকাবাসী বলছেন, 'ভুয়া মাজার।' কলাগাছকে ঘিরে গড়ে তোলা ভুয়া এই মাজারে ওরশের নামে ভন্ডামী ও অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে এলাকাবাসীর একাংশ।
চলতি মাসের ৫ জানুয়ারি কলাগাছের এই মাজারে ওরশের নামে অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধের দাবিতে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রায় একশত মানুষের গণস্বাক্ষরে একটি লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে।
অভিযোগের অনুলিপি দেয়া হয়েছে পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে।
লিখিত আবেদন ও এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৮৭ সালে ১০ জানুয়ারি বেলাব উপজেলার চরউজিলাব ইউনিয়নের বারৈচা গ্রামের চাঁন মিয়া শাহ মারা যান।
স্থানীয়ভাবে কলসীওয়ালা নামে পরিচিত এই ফকির মারা যাবার পর তাঁর দুই স্ত্রীর সংসারের সন্তানদের মধ্যে লাশ দাফন করা নিয়ে দেখা দেয় মতবিরোধ। তাঁর দুই স্ত্রীর বাড়ি একই গ্রামে।
পরে সামাজিকভাবে নেয়া সিদ্ধান্তে ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের বারৈচা গ্রামের মধ্যপাড়ায় প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের পুরাতন বসত বাড়ির আঙ্গিনায় তার লাশ দাফন করা হয়।
অপরদিকে বারৈচা দক্ষিণপাড়া গ্রামের ৯ নং ওয়ার্ডে দ্বিতীয় স্ত্রী ও সন্তানদের বসতভিটার আঙ্গিনায় কলা গাছের উপর আধ্যাত্মিক ব্যক্তির লাশের গোসল দেয়া হয়।
লাশ দাফনের পর গোসলের সময় ব্যবহৃত কলাগাছগুলো দেয়া হয় মাটিচাপা। ফলে দুই জায়গায় গড়ে তোলা হয় দুটি মাজার।
এরপর থেকে ৩৫ বছর ধরে চাঁন মিয়া শাহের পুরাতন বাড়িতে ওই ফকিরের কবরকে ঘিরে প্রতিবছর জানুয়ারির ১০ ও ১১ তারিখে ওরশ মাহফিল করেন ভক্তরা।
অপরদিকে বারৈচা দক্ষিণপাড়া গ্রামের ৯ নং ওয়ার্ডে চাঁন মিয়া শাহের দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়ির আঙ্গিনায় গোসলের স্থানে মাটিচাপা দেয়া কলাগাছের উপর তৈরী করা আরেকটি মাজারেও একই তারিখে ওরশ করেন ভক্তরা।
নতুন বাড়ির মাজারের নাম দেয়া হয় 'ফুলবাগান দরবার শরীফ।' এই দরবার শরীফের প্রথম পীরজাদা হন প্রয়াত ফকির চাঁন মিয়া শাহের বড় ছেলে মাসুম শাহ।
মাসুম শাহ বর্তমানে শিবপুর মডেল থানার একটি জোড়া খুন মামলার আসামি হয়ে জেল হাজতে রয়েছেন। তার অবর্তমানে ওই মাজারের পীরজাদা হন ছোট ছেলে ফরিদ শাহ।
আগামী ১০ ও ১১ জানুয়ারি ভুয়া মাজারে ওরশের আয়োজন করা হয়েছে। এখানে ওরশের নামে ভন্ডামী, মাদকের আসর ও অনৈতিক কার্যকলাপ করা হয় বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর।
প্রতি বছর ওরশের নামে অনৈতিক কার্যকলাপ,অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি ও নাচগানের কারণে মসজিদের মসুল্লিদের নামাজে ব্যাঘাতসহ শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়।তাই লাশবিহীন ওই ভুয়া মাজারের ওরশ বন্ধের দাবি করেছেন এলাকাবাসী।
অভিযোগকারী মুক্তার হোসেন বলেন, 'কলাগাছকে মাটিচাপা দিয়ে এখানে প্রায় ৩৫ বছর ধরে ওরশ করা হচ্ছে। ওরশের নামে এখানে গান বাজনা মাদকসহ নানা অপকর্ম হয়ে থাকে। তাই ওরশের নামে এসব অপকর্ম বন্ধ করার জন্য আমরা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।'
কলাগাছের মাজারের খাদেম প্রয়াত পীর চাঁন মিয়া শাহের দ্বিতীয় সংসারের ছেলে ফরিদ শাহের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আমাদের এখানে প্রয়াত চাঁন মিয়া শাহের দরবার শরিফ। এটি মাজার নয়।'
কলাগাছ দাফনের ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি তা কৌশলে এড়িয়ে যান।
অন্য মাজারের খাদেম প্রয়াত চাঁন মিয়া শাহের নাতি মোঃ বুরহান উদ্দীন বলেন, 'ওইখানে প্রথম কবর করা হয়েছিল। কিন্তু সে কবরে লাশ দাফন করা হয়নি। একারণে কলা গাছ দাফনের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে ওইখানে যেহেতু উনার ছেলেরা আছে তাই সেখানে ওরশ করতেই পারেন।'
বেলাব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোঃ তানভীর আহমেদ বলেন, 'লিখিত কোন অভিযোগ না পেলেও এ ব্যাপারে এলাকার কেউ একজন আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। দেখি কী করা যায়।'
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আয়শা জান্নাত তাহেরা বলেন, 'অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমি উভয়পক্ষকে ডাকবো। তারপর তাদের সাথে কথা বলে দেখি কী করা যায়।'