• নরসিংদী
  • মঙ্গলবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ; ২৯ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Advertise your products here

Advertise your products here

নরসিংদী  মঙ্গলবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ;   ২৯ এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
website logo

ভূমধ্যসাগরে নৌডুবিতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ৩৮ দিনেও খোঁজ মেলেনি


জাগো নরসিংদী 24 ; প্রকাশিত: রবিবার, ০৬ মার্চ, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ, ০৮:২০ পিএম
ভূমধ্যসাগরে নৌডুবিতে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ৩৮ দিনেও খোঁজ মেলেনি
নিখোঁজ ব্যক্তিদের ছবি

মো.শাহাদাৎ হোসেন রাজু : 'আমগো আর কষ্ট করতে হইব না, আমি সব কষ্ট দূর করইর‌্যা দিমু ইনশাল্লাহ।' ইতালির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগ মূহূর্তে লিবিয়া থেকে টেলিফোনে মা রুবি বেগমকে এ কথা বলেন নৌডুবিতে নিখোঁজ আল- আমিন ফরাজি। ওই সময় তিনি মাকে  কাকুতি মিনতি করে দালালদের পাওনা সাড়ে ৬ লাখ টাকা পরিশোধ করে দিতে অনুরোধ জানান, তা নাহলে তাকে লিবিয়া ফেলে রেখে অন্য সবাইয়ে গেইমিংয়ে (লিবিয়া থেকে নৌকা যোগে ইতালি)  পাঠিয়ে দিবে। ছেলের কষ্ট হবে জেনে আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে ধার কর্জ ও বাড়ীতে থাকা গহনা বন্ধক রেখে কোন রকমে সাড়ে ৪ লাখ টাকা জোগাড় করে স্থানীয় দালাল তারেক মোল্লার হাতে তুলে  দেন। 

ভূমধ্যসাগরে নৌডুবির ঘটনায় শনিবার সন্ধ্যায় নরসিংদীর ডৌকারচর এলাকার নিখোঁজ আল আমিন ফরাজির(৩৩) বাড়ীতে সরেজমিনে গেলে তার মা রুবি বেগম এই কথা জানান। 

এই সময় ওই বাড়ীতে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আল-অমিনের মা, বোন, স্ত্রী,  ছোট ভাই  ও সন্তানরা বিলাপের সুরে কাঁদতে থাকে। এসময় তাদের কান্নায় চারপাশ ভারি হয়ে উঠে। 

এসময় ‘আমার ভাই বেঁছে আছেতো' আল আমিন ফরাজির বোন ইতি আক্তার এই প্রতিবেদকের কাছে এমনই এক প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন। ইতি আক্তার বলেন, তাদের অভাব অনটনের সংসার। বাবা মারা যাবার পর বড় ভাই আল আমিন সংসারের ভার কাঁধে নেয় ।

ছোট ৪ ভাই বোন, মা ও স্ত্রী সন্তানসহ এতোবড় সংসারটি তিনি তার ছোট চাকরির আয় দিয়েই কোন রকমে টেনে নিয়ে আসছিল। তার ওপরেই ইতি ও অন্য ভাইদের পড়ালেখার খরচতো আছেই। 
ইতি জানায়, গত কয়েক মাস আগে ইতালি যাবে তার জন্য ভাবী সব গহনা নিয়ে বন্ধক দেয় এবং কয়েকজন আত্মীয়ের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নেয়।

ইতালি যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় বসবাস করে আমিরগঞ্জ ইউনিয়নের আগানগর এলাকার মনির নামে এক ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করেন। তার মারফতে যোগাযোগ হয় হাসনাবাদ এলাকার বাচ্চু মোল্লার ছেলে  তারেক মোল্লার সাথে সকল ধরনের লেন-দেন এবং যোগাযোগ রক্ষার কথা জানায় মনির। পরে তারেকের কাছে ইতালি যাবার জন্য সাড়ে ৩ লাখ টাকা দেয় আল-আমিন। বাকী টাকা সাড়ে ৬ লাখ টাকার মধ্যে সাড়ে ৪ লাখ আল-আমিন লিবিয়া থাকা অবস্থায় তার অনেক কষ্টে জোগাড় করে তারেকের হাতে দেয়। আজ তার ভাই বেঁচে আছে কি না সেটাও জানে না ইতি। 

শুধু ইতিই নয় ওই গ্রামের নৌকাডুবিতে নিখোঁজ হওয়া আলমগীরে স্ত্রী মৌসুমি, নাদিম সরকারের মা সামসুনাহার। 

আল–আমিনের বাড়ীতে বসেই ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে দেশে ফেরা হাজী ক্যাম্পে হোম কোয়ারেন্টানে থাকা ইউসুফ মৃধার সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে, তিনি জানান, গত ২৭ জানুয়ারি লিবিয়ার স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে দুই মিসরীয় চালক  ১২ ফুটের ছোট একটি বোটে তাঁদের ৩৫ জনকে নিয়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা হন।

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় মাল্টার কাছাকাছি পৌঁছলে ভোর ৩টার দিকে বোট একজন পড়ে যায়। তাকে তুলতে গিয়ে বোটটি পিছনের দিকে যাওয়ার সময় সামনের দিকে ভার বেশি থাকায় বোটটি উল্টে যায়।

ওই সময় তীব্র ঠান্ডা পানিতে প্রায় ১১ ঘণ্টা ভেসে ছিলেন তাঁরা। চোখের সামনে ১০-১২ জনকে মারা যেতে দেখেছেন। কূলকিনারাহীন সাগরে ঢেউয়ের ধাক্কায় একেক করে ভেসে গেছেন তাঁরা। তবে তাঁরা ছয়জন উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে অবস্থান করায় বেঁচে গেছেন। 

ইউসুফ মৃধা বলেন, ‘একটা সময় বহুদূরে কোস্টগার্ডের একটি জাহাজ ভেসে যেতে দেখি। আমাদের মধ্যে একজনের লাল জামা পরা ছিল, তাঁর জামা খুলে উড়াতে থাকি আমরা। পরে তারা এসে আমাদের সাতজনকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। উদ্ধার করে তীরে নেওয়ার পথেই রাশেদুলের মৃত্যু হয়। আমাদের ছয়জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর প্রায় এক মাস জেলে রেখে স্থানীয় দূতাবাসের সহযোগিতায় দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা হয়।

বৃহস্পতিবার সকালে আমরা দুজন দেশে ফিরেছি, অন্য চারজনও দ্রুতই দেশে ফিরবেন।’
তীব্র ঠান্ডায় ভেসে থাকার ১১ ঘণ্টা পর কোস্টগার্ডের সদস্যরা উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে অবস্থান করা জীবিত সাতজনকে উদ্ধার করেন। তবে তীরে পৌঁছার আগেই ঠান্ডায় জমে একজনের মৃত্যু হয়। ঘটনার ৩৫ দিন পেরিয়ে গেলেও ভূমধ্যসাগরে এখনো নিখোঁজ ২৮ জন, তাঁদের মধ্যে ১৫ জনই নরসিংদীর।

এত দিনেও নিখোঁজ ২৮ বাংলাদেশির কোনো সন্ধান না পাওয়ায় ধারণা করা হচ্ছে, তাঁদের সবারই মৃত্যূ হয়েছে। বেঁচে যাওয়া ইউসুফ মৃধা (২৯) নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মো. খোরশেদ মৃধার ছেলে ।

নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে নরসিংদীর ১৫ জনের নাম-পরিচয় জানা গেছে। তাঁরা হলেন রায়পুরার ডৌকারচরের নাদিম সরকার (২২), আলমগীর সরকার (৩৫), আল-আমিন ফরাজী (৩৩); দক্ষিণ মির্জানগরের এস এম নাহিদ (২৫); আমিরগঞ্জের ইমরান মিয়া (২১), আশিস সূত্রধর (২১), সবুজ মিয়া (২৫), হাইরমারার শাওন মিয়া (২২), সেলিম মিয়া (২৪); বেলাব উপজেলার আল আমিন (২৮); নারায়ণপুরের মতিউর রহমান (৩৭); সল্লাবাদের শরীফুল ইসলাম (২৪), সালাউদ্দিন (৩২), মো. হালিম (২৬), বিপ্লব মিয়া (২৪)। বাকি ১৩ জন ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর ও সিলেট জেলার বাসিন্দা।
নিখোঁজ আশীষের পিতা অনিল সূত্রধর জানান, রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদের তারেক মোল্লা নামের এক দালালের সাথে ইতালি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য আট লাখ টাকায় চুক্তি করেন তাঁরা।

ছয় লাখ টাকা তাঁর হাতে দেওয়ার পর গত ২৭ ডিসেম্বর তার ছেলেসহ অন্যান্যরা ইতালির উদ্দেশে রওনা হন। প্রথমে তাঁদের দুবাই নিয়ে এক সপ্তাহ রাখা হয়। পরে মিসর হয়ে তাঁদের পাঠানো হয় লিবিয়ার বেনগাজী শহরে। সেখানে খাদ্যসংকটে আরও প্রায় ১০ দিন থাকার পর ব্যক্তিগত গাড়ির ডেকের ভেতরে ভরে দুই দিনের যাত্রা শেষে তাঁদের নেওয়া হয় ত্রিপোলি শহরে।

সেখানে তাঁরা দেখা পান এই চক্রের মূল দালাল মনির চন্দ্র শীল নামের এক ব্যক্তির, যাঁর বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদে।

এব্যাপারে নিখোঁজ আশীষের পিতা অনিল সূত্রধর, নাদিম সরকারের পিতা ছোবহান সরকার ও আল-আমিন এর ভাই ইয়ামিন ফরাজী পৃথক পৃথকভাবে রায়পুরা থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।

এদিকে স্থানীয় দালাল তারেকের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের জন্য বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও নাম্বারটি লক করে রাখায় তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। পরে তার বড় ভাই  মামুন মোল্রার সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, 'আসলে আমি যতটুকু জানি ইতালি যাওয়ার জন্য নৌকাডুবিতে নিখোঁজ সকলে লিবিয়ায় অবস্থানরত মনির সাথে যোগাযোগ করেছে। শুধু মাত্র টাকা-পয়সা লেন-দেনের জন্য আমার ভাইয়ের ব্যাংক একাউন্ট ও তাকে ব্যবহার করা হয়েছে। তারপরেও  বলবো, আমার ভাই যদি এর সাথে সম্পৃক্ত থেকে থাকে  তবে তার বিচার হোক এতে আমাদের বলার কিছু থাকবেনা।'

অভিযোগের বিষয়ে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ( অপরাধ) সাহেব আলী পাঠান বলেন, 'অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিরা কি বৈধভাবে নাকি অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সব দিক পর্যালোচনা করে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আর যত দ্রুত সম্ভব দালাল তারেককে আইনের আওতায় আনা হবে।'

নরসিংদীর খবর বিভাগের জনপ্রিয় সংবাদ