হাবিবুর রহমান
কোরবানি শব্দের আরবি হলো কুরবান। ওই বস্তুকে কুরবান বলা হয় যার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভ করা হয়, তা পশু জবাইয়ের মাধ্যমে হউক বা যে কোন দান খয়রাতের মাধ্যমে হতে পারে।
আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট সময়ে নিদিষ্ট ব্যক্তির নির্দিষ্ট জানোয়ার জবাই করাকে কোরবানি বলে।
প্রকৃত পক্ষে এ ঘটনা ছিল ইব্রাহীম আঃ এর আত্মত্যাগের কঠিন পরীক্ষা। ইব্রাহীম আঃ উত্তীর্ন হলেন নিজ পুত্র ইসমাইল আঃ কে আল্লাহর হুকুমে কোরবানি দিতে স্বেচ্ছায় প্রস্তুতি গ্রহন করে। আমাদের এই কোরবানি প্রকৃত পক্ষে হযরত ইব্রাহীম আঃএর এই অতীত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতিচারন।
মানুষের নিজ স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে আত্মত্যাগী হওয়ার মহৎ অনুপ্রেরণায় ইসলামে কোরবানীর বিধান এসেছে। কিন্তু আমরা ধরনীর মায়ার মোহনজালে আবদ্ধ হয়ে ভুলে গেছি আত্মত্যাগ। আমরা আমাদের অর্জিত সম্পদের দাসত্ব করছি। ফলে দান বা ত্যাগের ধারণা শূন্যের কোঠায় উপনীত হয়েছে।
দানের পরিবর্তে গ্রহন,ত্যাগের পরিবর্তে লাভের স্পৃহায় মানুষের মানবিকতা ভুলে গিয়ে পাশবিকতা রূপ ধারণ করেছে। হেন অবস্হায় মানব হৃদয়ে পাশবিকতা বিনাশ না হলে মানবিকতা প্রকাশ সম্ভব নয়।
আল্লাহর রাহে নিজের সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার দীপ্ত শপথের নাম কোরবানি। কোরবানি দাতাকে বুঝতে হবে পশুর গলায় ছুড়ি চালানো নয়,এ ছুড়ি চালানো হচ্ছে কোরবানি দাতার নিজের প্রবৃত্তির গলায়। তখন তাকে ভাবতে হবে, সে যে তার নিজ সন্তানকে কোরবানি দেয়ার পরিবর্তে পশুকে কোরবানি দিচ্ছে। আল্লাহর প্রেমে নিজ সন্তান কে কোরবানি করলে যে ভারাক্রান্ত শোকের ছায়া নেমে আসতো সেই অনুভূতি পশুর গলায় ছুড়ি চালানো মাধ্যমে। অন্যথায় কোরবানীর স্বার্থকতা পাওয়া সম্ভব নয়। কবির ভাষায় ' তাকোয়া অর্জনে হতে মহীয়ান, নিজ পুত্র মনে করে দাও কোরবান'।
যে কোরবানীতে তাকোয়ার আবেগ অনুভূতি নেই, আল্লাহর দৃষ্টিতে সেই কোরবানীর কোন মূল্য হতে পারেনা। বনের পশুকে কোরবানীর মাধ্যমে মানের মায়ার দাগ কাটিলে হৃদয়ে আসবে শুদ্ধতা। এ শুদ্ধতা লাভের জন্যই তাকোয়া যা অর্জনের জন্য কোরবানীর ঈদুল আজহা। মানুষ আত্মস্বার্থ ত্যাগ না করে তাকোয়া ভুলে গিয়ে প্রতিযোগীতামুলক ভাবে গরু,মহিষ,ভেড়া, উট,দুম্বা জবাই করে উদর পুর্তি ভুঁড়ি ভোজে আনন্দ উপভোগ করে থাকে। আত্মীয় স্বজনদের কাছে নিজের নাম ফোটানোর জন্য বলে থাকে আমি অত লক্ষ টাকার কোরবানি দিয়েছি যেখানে কোরবানিতে প্রতিযোগীতার বহিঃপ্রকাশ বিদ্যমান।
আমি একটি বাস্তব ঘটনার সামান্য একটু ব্যক্ত করে মনের দাগকাটা অনুভূতি লাগব করতে ইচ্ছে হলো।
কোন এক বছর জনৈক সুনামধন্য বিত্তবান একটি বৃহৎ মহিষ উচ্চ মুল্যে ক্রয় করতঃ ঈদুল আজহার দিন মহিষটিকে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে বেধে যখন মৌলভী সাহেব গলায় ছুড়ি চালালেন, তখন মহিষের আংশিক গলা কাটার মুহূর্তে মহিষ প্রানে বাঁচার আশায় হঠাৎ পায়ের বাঁধন ছিঁড়ে প্রান বাঁচানোর জন্য লোকালয় ছেড়ে নির্জনে লোকানোর আশায় প্রানপনে দৌড়াতে থাকে। এমনি ভাবে ঘটনার স্থান থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে এক জঙ্গলে প্রান বাঁচানোর জন্য আশ্রয় নেয়। এ সময় গলা থেকে রক্ত ঝরছিল, চোখে ব্যথার জল টলমল করছে, হৃদয়ে যেন ছিল
বাঁচার আকুতি। কিন্তু না, তা আর হয়নি। কতিপয় ব্যক্তি ক্লান্ত মহিষটি আটক করে, জঙ্গলে ই তার বাঁচার আখাংকার অবসান ঘটায়।
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব তখনই প্রমানিত হয যখন সে শ্রষ্টার নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং তাই যদি হয় তবে স্বার্থান্নেসী হয়ে সে যা খুশী তাই করতে পারেনা। সৃষ্টির কল্যানে আত্মোপলব্ধি করে কর্ম সম্পাদন করাই তাকোয়ার সঠিক পন্হা।
পশু কোরবানীর সময় ভাবতে হবে আমার মধ্যে অসত্য, অপকর্ম অন্যায় উশৃংখলতা হিংসা বিদ্বেষ সহ যাবতীয় অনিয়ম ও পাশবিকতা কোরবানি দিয়ে আত্মশুদ্ধি গ্রহন করতে পেরেছি কি না। পশু কোরবানীর মাধ্যমে আমাদের মনের পশুত্ব কে বিসর্জন দিয়ে আত্মশুদ্ধির পথ প্রসারিত এবং তাকোয়া অর্জিত হলে ঈদুল আজহার সার্বিক স্বার্থকতা সফল হবে , এ প্রত্যাশা আমাদের মনে জাগ্রত হওয়া উচিত।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক