স্টাফরিপোর্টার: নীল আকাশে ধবধবে সাদা মেঘের ভেলার সাথে ভোরের মিষ্টি শিশিরের পরশ এবং শিউলি ফুলের গন্ধ জানান দিচ্ছে আসছে দেবী দুর্গা। স্মরণ করিয়ে দেয় বছর ঘুরে আবারও সুদূর কৈলাশ থেকে বাপের বাড়ি আসছেন উমা দেবী (দেবী দূর্গা) আসছে । প্রতিবছর শরৎকালে দেবী দূর্গা তার চার সন্তান গণেশ, কার্ত্তিক, লক্ষী আর সরস্বতীকে সাথে নিয়ে সমতল ভূমির এই বাংলায় বাপের বাড়ী বেড়াতে আসেন। আর মাত্র দিন কয়েক বাকী। দেবী দূর্গার আগমনকে ঘিরে নরসিংদীর সনাতন ধর্মালম্বীরা হয়ে উঠেছেন ব্যতি-ব্যস্ত।
নরসিংদী জেলার মন্ডপগুলোতে চলছে সাঝ-সজ্জ্বা, সেই সাথে প্রতিমালয়গুলোতে দেবী মূর্তি গড়া কাজ শেষ, গায়ে রঙ ছোঁয়ানোর অপেক্ষায় তুলি আচঁড়ে শিল্পি সত্ত্বাকে ফুটিয়ে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে মৃৎশিল্পিরা।
পুঞ্জিকা মতে গত রবিবার ( ২৫ সেস্টেম্বর) ছিল শারদীয় দুর্গোৎসবের পূণ্যলগ্ন, শুভ মহালয়া পিতৃপক্ষের শেষে দেবীপক্ষের শুরু। চন্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে দেবী দুর্গার আবাহনই মহালয়া। বাঙ্গালি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এ হচ্ছে দুর্গা দেবীর আগমনী বার্তা। আগামী শনিবার (১ অক্টোবর) থেকে শুরু হবে পূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। ৫ অক্টোবর বিজয়া দশমী দিনে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে ৫ দিনের এ ধর্মীয় উৎসব শেষ হবে।
এ বছর দেবী দুর্গার আসছে গজ বা হাতিতে চড়ে। এর ফলে বসুন্ধরা হবে শস্যপূর্ণ। আর দেবীর ফিরে যাবেন নৌকায় করে, যার অর্থ শস্য ও জলবৃদ্ধি। দেবীর এই আগমন ও গমনে যারা বিশ্বাস করেন, তাদের জন্য এ বছরটা সত্যিকার অর্থেই কল্যাণকর।
আগামী শনিবার (১ অক্টোবর) মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলেও মূলত মহালয়া থেকেই পূজারীরা দুর্গা মায়ের আগমন ধ্বনি শুনতে পান। শারদীয় দুর্গোৎসবকে ঘিরে নানা আয়োজনে ব্যস্ত নরসিংদীর হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ।
দূর্গা পূজা উপলক্ষে নরসিংদীর মন্দিরগুলোতে মন্ডপে মন্ডপে চলছে প্রতিমা সাজসজ্জার কাজ। প্রতিমালয়গুলোতে দেবী মূর্তি গড়ার কাজ প্রায় শেষ, তুলি আচঁড়ে শিল্পি সত্ত্বাকে ফুটিয়ে তুলে গায়ে রঙ ছোঁয়ানোর অপেক্ষায় মৃৎশিল্পিরা। আয়োজকরা ছুটছেন দর্জিপাড়ায়। মা দুর্গার লাল টুকটুকে বেনারসি শাড়ির জরির কাজ, গণেশের ধুতিতে নকশাদার পাড় বসানো আর মহিষাসুরের জমকালো পোশাক তৈরির কাজ। কেউবা ছুটছেন কামারপাড়ায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে বানিয়ে নিচ্ছেন দেবীর হাতের চক্র, গদা, তীর-ধনুক ও খড়গ-ত্রিশূল।
এদিকে ভীষণ ঘষামাজায় মন্ডপগুলোকে নতুন রূপে সাজিয়ে তুলতে ব্যস্ত মিস্ত্রিরা । ডেকোরেটর কর্মীদেরও ব্যস্ততার যেন শেষ নেই। আয়োজকদের ফরমায়েশ আর ডিজাইন অনুযায়ী গড়ে তুলছেন দৃষ্টিনন্দন অস্থায়ী পূজামন্ডপ। চলছে সংস্কারের শেষ কাজটুকু।
জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুব্রত কুমার দাস জানান, এবছর নরসিংদী জেলায় ৩৫৬ টি মন্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এরমধ্যে নরসিংদী পৌরসভায় ৩২টি ও মাধবদী পৌরসভায় ১৫টি সহ নরসিংদী সদর উপজেলায় ১০৩টি, পলাশ উপজেলায় ৪৬টি, শিবপুর উপজেলায় ৭২টি, মনোহরদী উপজেলায় ৫২টি, বেলাব উপজেলায় ২২টি এবং রায়পুরা উপজেলায় ৬২টি মন্ডপে দেবী দুর্গার আরধনা করবে পূজারীরা।
তিনি বলেন, দুর্গা পূজা উদযাপনে ইতোমধ্যে সবধরনে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ। মণ্ডপগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। মণ্ডপগুলোতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হবে।
নরসিংদীর মৃম্ময়ী প্রতিমালয়ের স্বত্বাধিকারী প্রতিমাশিল্পী সম্ভুনাথ পাল জানান, ‘প্রতিমা তৈরিতে মূলত মাটি, বাঁশ-খড়, দড়ি, লোহা, ধানের কুঁড়া, পাট, কাঠ, রঙ, বিভিন্ন রঙের শিট ও শাড়ি-কাপড়ের প্রয়োজন হয়। প্রতিমা গড়া শেষ হলে রংতুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হয় অবয়ব। প্রতিমা তৈরি করা অনেক কষ্টের। বছরের অন্যান্য সময় তেমন কাজ না থাকলেও এই সময় ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তবে সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও সে অনুযায়ী প্রতিমা তৈরির মজুরি বাড়েনি।
তিনি বলেন, এবছর তার কারখানায় ৫ জন কারিগর নিয়ে সর্বাধিক ১৮টি প্রতিমা তৈয়ার করেন।
নরসিংদীর তুর্য্য প্রতিমা শিল্পালয়ের স্বত্বাধিকারী দুলাল পাল জানান, ‘পূজা শুরুর আগেই প্রতিমা তৈরির কাজ সম্পন্ন করতে মৃৎশিল্পীরা বিরামহীনভাবে কাজ করছেন। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে তাদের কর্মযজ্ঞ। চাহিদামত প্রতিমাকে গড়ে তুলতে চেষ্টার কোনও কমতি নেই।’
তিনি বলেন, ‘ এবছর প্রতিমা তৈরির কাঁচামালের দাম যেহারে বেড়েছে কিন্তু প্রতিমাগুলোর দাম সেভাবে পাচ্ছিনা। তাতে লোকসান ঘুনা ছাড়া আমাদের কোন গতি নেই।
বিশ্বকর্মা প্রতিমা শিল্পালয়ের সঞ্জিত পাল বলেন, প্রতিমা তৈরিতে প্রচুর কাঁচাপণ্যের প্রয়োজন হয়। তবে বাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় এবার প্রতিমা তৈরিতে খরচ অনেকটাই বেড়েছে। এরই মধ্যে প্রতিমা তৈরি শেষ। এখন চলছে সাজসজ্জার কাজ।’ বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে অজন্তা, অরিয়েন্টেল, দেবী ও স্বাম্য নামে চার প্রকারের প্রতিমা তৈরি করেন মৃৎশিল্পীরা। নরসিংদীর আয়োজকদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে অজন্তা প্রতিমা।
নরসিংদী জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের আহবায়ক অনিল চন্দ্র ঘোষ জানান, ‘সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপূজা। প্রতি বছরের মতো বিগত দুইবছর করোনার কারণে উৎসবটি অতটা জাকজমকভাবে উদযাপন করা না গেলেও। এবার সেই অবস্থা না থাকায় মোটামুটি জাকজমকপূর্ণ ভাবেই আমাদের এই ধর্মীয় উৎসব পালন করা হবে।
ইতোমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। এখন প্রতিমা তৈরি এবং প্যন্ডেল নির্মাণের কাজ চলছে। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের সাথে আলাদা আলাদা বৈঠক হয়েছে। পূজা নির্বিঘে করতে প্রশাসন থেকে আমরা সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস পেয়েছি।’
এদিকে আসন্ন দুর্গাপূজায় আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহনে জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান।